আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

ঈমানের সংজ্ঞা কেন্দ্রিক খুঁটিনাটি কয়েকটি বিষয় ছাড়া ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক আলিমগণ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে আকীদা বিষয়ক কোনো অভিযোগ ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে আকীদাগত কোনো আপত্তি না থাকার বড় প্রমাণ যে, তাঁর সমসাময়িক ও তাঁর ছাত্র পর্যায়ের প্রায় সকল প্রসিদ্ধ ফকীহ, ইমাম, ও মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন, অনেকেই তাঁকে নিজেদের ইমাম বলে উল্লেখ করেছেন, সাধারণ মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেছে, তাঁর মত ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, উমাইয়া ও আববাসী প্রশাসন তাঁকে বিচারক পদে বসানোকে নিজেদের সম্মানের বিষয় বলে গণ্য করেছে। কিন্তু এরপরও তৃতীয় শতক থেকে আকীদা বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ উত্থাপিত হতে লাগল। যেমন, তিনি বিদআতী আকীদার উদ্ভাবক, মুতাযিলী, মুরজিয়া, হাদীস অমান্যকারী..., অস্ত্রধারণে বিশ্বাসী... ইত্যাদি। বস্ত্তত আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিববান, ইবন আদী ও খতীব বাগদাদী ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সংকলন করেছেন সনদ যাচাই না করে সেগুলো গ্রহণ করলে মনে হবে, ইসলামী আকীদার এমন কোনো খারাপ বিষয় নেই যা ইমাম আবূ হানীফার মধ্যে ছিল না। অভিযোগগুলো পর্যালোচনার আগে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

(১) ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বর্ণিত এ সকল অভিযোগের অধিকাংশই সনদ বিচারে জাল বা বাতিল। নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা, বিদ্বেষ চরিতার্থ করা বা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের প্রিয়ভাজন হতে অনেক জালিয়াত এ সকল জাল কাহিনী প্রচার করেছে।

(২) সমসাময়িক আলিমদের মধ্যকার মতবিরোধ একটি দুঃখজনক কিন্তু স্বাভাবিক বিষয়। খুঁুটিনাটি কয়েকটি আকীদাগত মতভেদের কারণে সমসাময়িক কয়েকজন মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক কঠোর মন্তব্য করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তাঁর মতের ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁকে নিন্দা করেছেন। আমরা পরবর্তীতে দেখব যে, এ সকল ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা নীরবতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য অবলম্বন করতেন।

(৩) সমকালীন আলিমদের মধ্যকার মতবিরোধ উস্কে দিতে বা অপব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকে অনেক বিভ্রান্ত, দুর্বল ঈমান বা চাটুকার। ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বর্ণিত ঘটনাগুলোতে আমরা এর অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। এরূপ অনেক ব্যক্তি নিজের বিভ্রান্তির ছাফাই গাইতে, তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে বা বিরোধী আলিমের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য তাঁর নামে বিরোধী আলিমের কাছে তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা সম্পূর্ণ মিথ্যা এমন কথা বলেছে যা কখনোই তিনি বলেন নি। আর এরূপ কথা শুনে উক্ত বিরোধী আলিম ইমাম আবূ হানীফার প্রতি আরো বিক্ষুদ্ধ হয়েছেন ও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।

৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও আকীদা বিশেষজ্ঞ ইমাম শাহরাস্তানী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল কারীম ইবন আহমদ (৪৬৭-৫৪৮ হি) মুরজিয়া ফিরকার ‘‘গাস্সানিয়া’ নামক দলের প্রধান কূফার ‘গাস্সান’ নামক ব্যক্তির বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন:


ومن العجيب أن غسان كان يحكي عن أبي حنيفة رحمه الله مثل مذهبه ويعده من المرجئة ولعله كذب كذلك عليه


‘‘আশ্চর্য বিষয় যে, গাস্সান প্রচার করত যে, আবূ হানীফা (রাহ)-এর মত তাঁর মতেরই মত এবং সে তাঁকে মুরজিয়া হিসেবে প্রচার করত। সম্ভবত এগুলিও তাঁর নামে এ ব্যক্তির মিথ্যাচার।’’[1]

আমরা সামান্য কয়েকটি অভিযোগ পর্যালোচনা করব।


[1] শাহরাসতানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/১৪০।