ব্যাংকের সুদ কি হালাল সূচি ও বিবরন শাইখ মুশ্তাক আহমাদ কারীমী ১ টি

একটি যুক্তি এও পেশ করা হয়ে থাকে যে, যে ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখে এবং তার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণে সূদ গ্রহণ করে, সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মতই যে তার জমি অপরকে ঠিকা দেয় এবং তার নিকট থেকে চুক্তিমত নির্দিষ্ট পরিমাণে ভাড়া গ্রহণ করে। সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তার জমিতে ফসল হল, কি না হল তার খেয়াল ও পরোয়াই করে না। বরং সে শুধুমাত্র তার জমি চাষ করতে দিয়েই তার ভাড়ার অধিকারী হয়ে যায়।

কিন্তু লক্ষণীয় যে, উক্ত যুক্তিতে বিভ্রান্তিকর হেত্বাভাস ব্যবহার করা হয়েছে। এ কথাটিকে যদি আমরা ফিক্হী ভাষায় বলি, তাহলে বলতে পারি যে, এ যুক্তিতে জমির উপর টাকাকে এবং ভাড়ার উপর সূদকে কিয়াস করা হয়েছে। অথচ এমন কিয়াস মুলেই অচল। কেননা, কিয়াস সহীহ ও শুদ্ধ হওয়ার জন্য (অনুমেয় ও অনুমিত উভয়ের) ইল্লত বা হেতু অভিন্ন হওয়া আবশ্যিক। আর এখানে সেই হেতু অভিন্ন নয়। জমি ঠিকার উপর দেওয়ার ইল্লত (হেতু) হল, জমির সত্ত্ব ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যায়। পক্ষান্তরে টাকা যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ তার সত্ত্ব দ্বারা লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। কারণ টাকার সত্ত্ব কারোরই ঈপ্সিত নয়। (ঈপ্সিত হল তার বিনিমেয়।) ইমাম গায্যালী (রঃ) তাই বলেছেন। (ইহ্য়্যাউল উলূম ৪/৮৮) অনুরূপভাবে টাকা পয়সার মান জমি থেকে ভিন্নতর। আর এই ভিন্নতা থাকার কারণেই উক্ত কিয়াস (অনুমিতি) শুদ্ধ নয়।

পক্ষান্তরে জমি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা ইজারার পর্যায়ভুক্ত যা যুক্তি ও হিকমতপূর্ণ ইসলামে বৈধ করা হয়েছে। ইজারাতে মূল সত্ত্ব ভাড়া দেওয়া হয় এবং তা ব্যবহার করে উপকৃত হওয়ার দরুন ব্যবহারকারীর নিকট থেকে কিছু ভাড়া নেওয়া হয়। পরন্তু তার মূল সত্ত্ব বিনষ্ট হয়ে যায় না। আর টাকা-পয়সা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারটা হল ইহসান ও পরহিতৈষিতার পর্যায়ভুক্ত। আর এই জন্যই এর উপর মজুরী বা ভাড়া নেওয়া অবৈধ।

সুতরাং এর মধ্যে এবং জমি ভাড়া দেওয়ার মধ্যে রয়েছে বড় পার্থক্য। এই পার্থক্যটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝুনঃ- মনে করুন, এক ব্যক্তি তার জমি অপর ব্যক্তিকে বার্ষিক ৫০০ টাকা হিসাবে ঠিকায় দিল। উক্ত ৫০০ টাকা হল এ জমির মূল সত্ত্ব দ্বারা উপকৃত হওয়ার ভাড়া। পরন্তু সারা বছর চাষ করার ফলেও জমির সত্ত্ব বিনষ্ট হয় না।

ধরে নেওয়া যাক, বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ষষ্ঠ মাসে এ জমিটি নদীর ধসে নষ্ট হয়ে গেল। এমতাবস্থায় জমির মালিক ২৫০ টাকা ঠিকাদারকে অবশ্যই ফেরৎ দেবে। কেননা, জমির সেই মূল সত্ত্ব যার দ্বারা ঠিকাদার লাভবান হয়ে আসছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। অতএব সে ভাড়া কেন আদায় করবে? পক্ষান্তরে ঋণের প্রসঙ্গটা ঠিক এর বিপরীত। ধরে নিন, ঋণের নেওয়া টাকা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে হারিয়ে গেল অথবা পুড়ে গেল। এমতাবস্থায় ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার নিকট থেকে এই দাবী করতে পারে না যে, তোমার টাকা যেহেতু নষ্ট হয়ে গেছে, সেহেতু তুমি আমাকে পুনর্বার ঋণ দাও। বরং এই ক্ষতি ঋণগ্রহীতাকেই বহন করতে হবে।

বুঝা গেল যে, জমি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারের উপর ঋণ দেওয়ার ব্যাপারকে কিয়াস করা এবং এই কিয়াস ও যুক্তি দ্বারা ব্যাংকের সূদকে হালাল করা আদতেই সঠিক নয়।

উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা থেকে আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, ব্যাংকের সূদ হালালকারিগণ বিভিন্ন দুর্বল ও ভিত্তিহীন দলীল প্রয়োগ করে সরলমনা মুসলমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন।