আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী ভূমিকা (المقدمة) শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ২ টি

بسم الله الرحمن الرحيم

সৃষ্টিজগতের প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য সমস্ত প্রশংসা। তিনি আমাদেরকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করার আদেশ করেছেন এবং তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদের মুখাপেক্ষী নন; বরং আমরাই তার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾

‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
তাওহীদ (একত্ব) এর দিকে আহবান করা এবং ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর সাথে তার ইবাদত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলগণকে পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾

‘‘তোমার পূর্বে আমি যাকেই রসূল হিসাবে প্রেরণ করেছি, তাকে আদেশ প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করো’’। (সূরা আল আম্বীয়া: ২৫)


وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ولو كره المشركون، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله إلى الناس أجمعين، صلى الله عليه وعلى آله وأصحابه الذين هاجروا وجاهدوا وصبروا والذين آووا ونصروا وسلم تسليما كثيرًا إلى يوم الدين.

অতঃপর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ  নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনো শরীক নেই। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে থাকে।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল। তিনি তাকে সমস্ত মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার উপর, তার পরিবারের উপর এবং তার ঐসব সাহাবীর উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তার সাথে হিজরত করেছে, জিহাদ করেছে এবং ধৈর্যধারণ করেছে। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব আনসার সাথীর উপরও সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তাকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছে ও তাকে সাহায্য করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অজস্র শান্তির ধারা বর্ষিত হোক। আমীন
অতঃপর, পরিশুদ্ধ আকীদার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা এবং তার দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কেননা এর উপরই আমলের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাদের অনুসারীগণ সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সে সঙ্গে তারা ঐসব বিষয় থেকেও সতর্ক করেছেন, যা মানুষের আকীদাকে নষ্ট করে অথবা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে।
কুরআনুল কারীমের আয়াতগুলোতে এ দিকটির প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াতে মানুষের আকীদা-বিশ্বাস সংশোধনের গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি।
মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেস-একনিষ্ঠ করার আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন তার জন্য মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম কাবাঘরের মূর্তিগুলো ভাঙতে শুরু করলেন এবং সেটার নিশানা-চিহ্ন মুছে ফেলতে লাগলেন। সে সঙ্গে তিনি ইখলাসের সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার হুকুম করলেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার  কোনো শরীক নেই।


এ উম্মতের আলেমগণ তাদের পরিশ্রমের বিরাট অংশ আকীদা সংশোধনের জন্য ব্যয় করেছেন, তারা এ উদ্দেশ্যেই জিহাদ করেছেন, উম্মতের লোকদেরকে ইহা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এর উপর অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আকীদা ও তাওহীদের কিতাবসমূহ ইসলামী পাঠাগারের বিরাট স্থান দখল করেছে। পাঠাগারের কিতাবগুলোর তালিকার সূচনাতেই রয়েছে আকীদার বইগুলোর নাম।
তাই এ বিরাট কাজে আমার সামান্য শ্রম ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করে কিতাবটি লেখার কাজে হাত দিলাম। কিতাবটি আমি পাঠকদের সামনে পেশ করছি। এতে আমি নতুন কিছু সংযোজন করিনি। নির্ভেজাল তাওহীদ ও সহীহ আকীদাকে ভালোভাবে বুঝার জন্য এ সংক্রান্ত কিছু ভুলভ্রান্তি পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। সে সঙ্গে বর্তমান সময়ের মানুষ সহীহ আকীদার ক্ষেত্রে যে ভুল-ভ্রান্তির চর্চা করছে এখানে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, যাতে করে মানুষের কাছে এগুলোর হুকুম পরিষ্কার হয়ে যায় এবং যারা ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে, তাদের কাছে সেসব ভুল-ভ্রান্তি পরিষ্কার হয়। এতে সম্ভবত তারা সত্যের দিকে ফিরে আসবে এবং অন্যদেরকে এ দিকেই ফিরে আসার নছীহত করবে। আশা করা যায় যে, তারা সতর্ক হবে।  
আমি এ কিতাবের বিষয়গুলো দীনের ইমাম ও মুসলিমদের আলেমগণের কিতাব থেকে সংগ্রহ করেছি। যেমন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে কাছীর, শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব এবং তার ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা তাওহীদ ও আকীদা সংশোধন-সংস্কারের দাওয়াতে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে আমি কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা ফাতহুল মাজীদের উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছি। সুতরাং আমি দাবি করছি না যে, আমি এতে নতুন কিছু নিয়ে এসেছি। আমি কেবল কিছু জানা বিষয়কে পাঠকদের বোধশক্তির কাছাকাছি করেছি মাত্র। যখনই কোনো বিষয় বর্ণনা করেছি, তখন সুযোগ বুঝে সেগুলোকে বর্তমান সময়ের মানুষের বাস্তব অবস্থার সাথে মিলিয়ে দিয়েছি মাত্র।


এ কিতাবের মূল বিষয়গুলো সৌদি আরব থেকে প্রচারিত আল-কুরআনুল কারীম রেডিওর বিভিন্ন ইলমী মজলিসে প্রচার করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক না হলে বিষয়গুলো কিতাব আকারে প্রকাশ পেতো না। সে সঙ্গে কতিপয় দীনি ভাই আমার কাছে এগুলোকে একত্র করে সাজিয়ে-গুছিয়ে বই আকারে প্রকাশ করার প্রস্তাবও করেছেন। ইনশা-আল্লাহ এগুলো দ্বারা মানুষ দীর্ঘদিন উপকৃত হবে এবং এর কল্যাণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে অবদানও রাখতে পারবো। বিশেষ করে যখন দীনের সঠিক দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা বিরাজ করছে, আকীদা সংশোধনের দাওয়াত না দিয়ে অনেক দাঈ যখন তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি বেশী গুরুত্ব প্রদান করছে এবং বলতে গেলে আকীদার বিষয়গুলো ছেড়েই দিয়েছে, তখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে এ বিষয়ে বই-পুস্তক লেখার গুরুত্ব আরো বেশী হয়ে দাড়িয়েছে।
বর্তমান সময়ে অনেক দাঈ লোকদেরকে বিভিন্ন সমাধিস্থল ও মাযারে শিরকে আকবার, বিদআত ও কুসংস্কারে ডুবে থাকতে দেখে এবং গোমরাহীর আহবানকারীদেরকে মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের উপর জয়লাভ করতে দেখেও তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ গোমরাহী ইমামগণ অজ্ঞ মানুষগুলোকে অলী-আওলীয়াদের কবর ও মাযারের দিকে টেনে নিচ্ছে। অলীদের কবরগুলোকে মানুষের জন্য উৎসবের স্থানে পরিণত করছে, তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও ধন-সম্পদ নিয়ে খেল-তামাশা করছে। এসব ভ- অন্যায়ভাবে অজ্ঞ লোকদের স্বঘোষিত নেতা হয়েছে এবং তারা আলেম ও আল্লাহর অলী হওয়ার দাবি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে।


আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে এমন অনেক দাঈ রয়েছে, যারা আকীদা সংশোধনের দিকে কোনো গুরুত্ব দেন না। তাদের কেউ কেউ বলে থাকেন, লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ আকীদার উপর বহাল থাকতে দাও এবং তাদের কাজের প্রতিবাদ করতে যেয়ো না। লোকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করো এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করো না। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, لنجتمع على ما اتفقنا عليه وليعذر بعضنا بعضا فيما اختلفنا فيه অর্থাৎ যে বিষয়ে আমরা সকলেই একমত তার উপর ঐক্যবদ্ধ হবো এবং যাতে আমরা মতভেদ করেছি, তাতে আমরা পরস্পরকে ছাড় দিবো। তারা এ রকম অন্যান্য বাক্যও বলেছেন, যা আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের সুস্পষ্ট বিরোধী। উল্লেখ্য যে, এখানে তারা যে ঐক্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা দ্বারা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝিয়েছেন। আর যাতে উম্মত মতভেদ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন, তা দ্বারা তারা আকীদা ও তাওহীদকে বুঝিয়েছেন। তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল।
আসল কথা হলো, আকীদার ক্ষেত্রে উম্মতের প্রথম যুগের আলেমগণ মোটেই মতভেদ করেননি এবং এক্ষেত্রে কোনো মতভেদ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক (কর্তৃত্বশীল ও বিদ্বান) তাদেরও। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’’। (সূরা আন নিসা: ৫৯)
আমাদের সকলের জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়া এবং তার বিরোধীতা বর্জন করা ব্যতীত মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তি অর্জন হওয়ার কোনো আশা নেই। বিশেষ করে আকীদার বিষয়ে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। কেননা এটিই তাদের দীনের মূল বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا﴾

 ‘‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জুকে মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
মদীনার ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বর্ণনা করেছেন। এটি একটি বিরাট কথা। মুসলিমদের উচিত কথাটি ভালোভাবে বুঝা এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। তিনি বলেছেন,


لا يَصْلُحُ آخِرُ هذه الأمةِ إلا بما صَلَحَ به أوَّلُها

‘‘এ উম্মতের প্রথম যুগের লোকেরা যার মাধ্যমে সংশোধিত হয়েছে, তা ব্যতীত শেষ যুগের লোকদের সংশোধন হওয়া অসম্ভব।
আল্লাহ তা‘আলাই সঠিক পথের তাওফীক দাতা, তিনিই সঠিক পথের সন্ধান দাতা।

وصلى الله وسلم على نبينا محمد و آله وصحبه

দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর।

ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান

শাইখ ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান হাফিযাহুল্লাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী

শাইখ ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ আল-কাসীম অঞ্চলের বুরায়দাহ শহরের নিকটবর্তী শামাসীয়ার অধিবাসী। তিনি ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখ মোতাবেক ১ রজব ১৩৫৪ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থাকতেই তার পিতা মারা যান। অতঃপর তিনি ইয়াতীম অবস্থায় স্বীয় পরিবারে প্রতিপালিত হন। শহরের মসজিদের ইমামের নিকট তিনি কুরআনুল কারীম, কিরা‘আতের মূলনীতি এবং লেখা শিখেন।
শামাসিয়ায় ১৩৬৯ হিজরী সালে যখন সরকারী মাদরাসা চালু করা হয়, তখন তিনি সেখানে ভর্তি হন। অতঃপর বুরায়দা শহরস্থ ফয়সালীয়া ইবতেদায়ী মাদরাসায় ১৩৭১ হিজরী সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এ সময় তাকে ইবতেদায়ী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অতঃপর বুরায়দাতে ১৩৭৩ হিজরী সালে যখন ইসলামিক ইন্সটিটিউট খোলা হয়, তখন তিনি তাতে ভর্তি হন। ১৩৭৩ হিজরী সালে তিনি এখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি রিয়াদ শহরস্থ কুলদীয়া শারঈয়া বা শারঈয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৩৮১ হিজরী সালে শিক্ষা সমাপনী ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী ফিকাহর উপর এম,এ পাস করেন এবং একই বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্ম জীবন:
শারঈয়া কলেজ থেকে ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি রিয়াদস্থ ইসলামিক ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অতঃপর তাকে শারঈয়া কলেজের শিক্ষক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর তাকে ইসলামী আকীদা বিভাগের উচ্চতর শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অতঃপর তাকে বিচার বিষয়ক উচ্চতর ইন্সটিটিউটে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অতঃপর তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষে তাকে পুনরায় সেখানে শিক্ষক হিসাবে ফিরে আসেন। অতঃপর তাকে ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য নিয়োগ করা হয়। তিনি এখানো এই পদে বহাল রয়েছেন।
তিনি আরো যেসব সরকারী দায়িত্ব পালন করেন, তার মধ্যে هيئة كبار العلماء এর সদস্য, মক্কা মুকাররামায় অবস্থিত রাবেতার পরিচালনাধীন ইসলামী ফিকাহ একাডেমীর সদস্য, ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য, হজ্জ মৌসুমে দাঈদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্য এবং রিয়াদ শহরের মালায এলাকার আমীর মুতইব ইবনে আব্দুল আযীয আল-সউদ জামে মসজিদের ইমাম, খতীব ও শিক্ষক। তিনি সৌদি আরব রেডিওতে نور على الدرب নামক প্রোগ্রামে শ্রোতাদের প্রশ্নের নিয়মিত উত্তর প্রদান করেন।
এ ছাড়াও তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, গবেষণা, অধ্যায়ন, পুস্তিকা রচনা, ফতোয়া প্রদান করাসহ বিভিন্নভাবে ইলম চর্চা অব্যাহত রখেছেন। এগুলো একত্র করে কতিপয় পুস্তকও রচনা করা হয়েছে। তিনি মাস্টার্স ও ডক্টরেক ডিগ্রী অর্জনার্থী অনেক ছাত্রের গবেষণা কর্মে তত্বাবধায়ন করেছেন।

শাইখের উস্তাদবৃন্দ:
১) মান্যবর শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে সা’দী, ২) শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায, ৩) আব্দুল্লাহ ইবনে হুমায়েদ, ৪) শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমীন শানকিতী, ৫) শাইখ আব্দুর রায্যাক আফীফী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুর রাহমান আস-সুকাইতী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে ইবরাহীম আল-বুলাইহী, ৭) শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইল, ৮) শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে সালেহ আলখুলাইফী, ৯) শাইখ ইবরাহীম ইবনে উবাইদ আল-আব্দ আল-মুহসিন, ১০) শাইখ হামুদ ইবনে উকালা আশ শুআইবী, ১১) শাইখ সালেহ আল-ইলদী আন্ নাসের। এ ছাড়াও আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ধার্মিক শাইখের কাছ থেকে হাদীছ, তাফসীর এবং আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।  

শাইখের ছাত্রগণ:
১) শাইখ ড. আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আল-সাদহান, ২) শাইখ আলী ইবনে আব্দুর রাহমান আশ শিবিল, ৩) শাইখ সাগীর ইবনে ফালেহ আলসাগীর, ৪) শাইখ ইউসুফ ইবনে সা’দ আলজারীদ, ৫) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামাদ আল-উসাইমী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামাদ আলউসাইমী, ৭) মাসজিদুল হারামের ইমাম শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে সুদাইস, ৮) মসজিদে নববীর ইমাম শাইখ আব্দুল মুহসিন আল কাসিম, ৯) শাইখ সালেহ ইবনে ইবরাহীম আলুস-শাইখ, ১০) শাইখ আয্যাম মুহাম্মাদ আল শুআইর। এ ছাড়াও তার অনেক ছাত্র রয়েছে। তারা নিয়মিত তার মজলিসে এবং নিয়মিত দারসগুলোতে অংশ গ্রহণ করতেন।

শাইখের ইলমী খেদমত:
লেখালেখির কাজে রয়েছে শাইখের অনেক খেদমত। তার মধ্য থেকে নিম্নে কতিপয় গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো।
১) التحقيقات المرضية في المباحث الفرضية এটি ইলমে ফারায়েযের উপর রচিত শাইখের একটি কিতাব। এটি ছিল মাস্টার্স পর্বে তার গবেষণার বিষয়। বইটি এক খন্ডে ছাপানো হয়েছে।
২) أحكام الأطعمة في الشريعة الإسلامية ইসলামী শরী‘আতে খাদ্যদ্রব্যের বিধিবিধান।
৩) الإرشاد إلى صحيح الاعتقاد। আমরা এর বাংলা নাম দিয়েছি সহীহ আকীদার দিশারী। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
৪) شرح العقيدة الواسطية আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম ইমাম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার আল আকীদাতুল ওয়াসেত্বীয়ার ব্যাখ্যা ‘‘শারহুল আকীদা আল ওয়াসেত্বীয়া’’ এটি। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
৫) البيان فيما أخطأ فيه بعض الكتاب এটি একটি বড় মাপের কিতাব। এতে তিনি বিভিন্ন কিতাবের ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরেছেন।
৬) مجموع محاضرات في العقيدة والدعوة আকীদা ও দাওয়া বিষয়ে শাইখের বিভিন্ন লেকচার এখানে জমা করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
৭) الخطب المنبرية في المناسبات العصرية যুগোপযোগী অনেক বিষয়কে একত্র করে জুমু‘আর খুৎবা হিসাবে লেখা হয়েছে। এটি দু’খ-- ছাপানো হয়েছে।
৮) ইসলামের সংস্কারক ইমামগণ
৯) বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তিকা
১০) বিদআত থেকে সাবধান। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
১১) مجموع فتاوى في العقيدة والفقه ফতোয়া ও আকীদা বিষয়ক সংকলন
১২) شرح كتاب التوحيد- للإمام محمد بن عبد الوهاب এটি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহিমাহুল্লাহর লিখিত কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা।
১৩) الملخص الفقهي ফিকাহর উপর লিখিত শাইখের এটি একটি বিশাল কিতাব।
১৪) إتحاف أهل الإيمان بدروس شهر رمضان রমাদ্বান মাসের জন্য খাস করে অনেকগুলো দারস এখানে জমা করা হয়েছে।
১৫) হজ ও উমরাহকারীর জন্য যা করণীয়
১৬) কিতাবুত তাওহীদ। এটি সৌদি আরবের স্কুলসমূহে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
১৭) কিতাবুদ দাওয়া
১৮) রমাদ্বানুল মুবারকের মজলিস
১৯)  عقيدة التوحيد আকীদাতুত তাওহীদ। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
২০) كشف الشبهات এর ব্যাখ্যা।
২১) যাদুল মুসতাকনি
২২) الملخص في شرح كتاب التوحيد এটি কিতাবুত্ তাওহীদের ব্যাখ্যা।
২৩) شرح مسائل الجاهلية এটি জাহেলী যুগের অনেক শিরক, কুফর এবং কুসংস্কারের প্রতিবাদে লিখিত হয়েছে। এটি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহিমাহুল্লাহ এর লিখিত মাসাঈলিল জাহিলিয়াহ নামক পুস্তিকার ব্যাখ্যা ‘‘শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ’’। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
২৪) حكم الاحتفال بذكرى المولد النبوي নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিবস উপলক্ষে মীলাদ উদ্যাপন করা।
২৫) الإيمان بالملائكة وأثره في حياة الأمة ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান এবং মানব জীবনে তার প্রভাব।
২৬)  مجمل عقيدة السلف الصالحসালাফদের আকীদার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
২৭) حقيقة التصوف  সুফীবাদের হাকীকত।
২৮) من مشكلات الشباب যুবকদের সমস্যা
২৯) وجوب التحاكم إلى ما أنزله الله আল্লাহর বিধান দিয়ে বিচার-ফায়ছালা করা আবশ্যক
৩০) من أصول عقيدة أهل السنة والجماعة আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকীদা
৩১) دور المرأة في تربية الأسرة পরিবার পরিচালনায় নারীর ভূমিকা
৩২)  معنى لا إله إلا الله লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর ব্যাখ্যা
৩৩) شرح نواقض الإسلام ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা
৩৪) التوحيد في القران কুরআনুল কারীমে তাওহীদ
৩৫) سلسلة وصايا وتوجيهات للشباب ১-৪ যুবকদের জন্য কতিপয় উপদেশ ও নির্দেশনা সিরিজ ১-৪

শাইখের প্রশংসায় বিভিন্ন আলিমের মন্তব্য:
সৌদি আরবে যে সব বিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ আলিম এখনো জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে শাইখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, শাইখ ইবনে বায রহিমাহুল্লাহকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার পরে আমরা কার কাছে দীনের বিষয়াদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো? জবাবে ইবনে বায রহিমাহুল্লাহ বললেন, আপনারা সালেহ ফাওযান জিজ্ঞসা করবেন। এমনি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালিহ আল-উছাইমীন রহিমাহুল্লাহকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা আপনার পরে কাকে জিজ্ঞাসা করবো? তিনি জবাব দিলেন যে, আপনারা সালিহ ফাওযানকে জিজ্ঞাসা করবেন। কেননা তিনি একজন ফকীহ এবং ধার্মিক। শাইখ ইবনে গুদাইয়্যান প্রায়ই বলতেন, আপনারা দীনের ব্যাপারে শাইখ সালেহ ফাওযানকে জিজ্ঞাসা করবেন। আল্লাহ যেন তার আনুগত্যের উপর তার বয়স বৃদ্ধি করেন, তার শেষ পরিণাম যেন ভালো করেন এবং যেন হকের উপর তাকে টিকিয়ে রাখেন।


আমরা শাইখের জন্য দু‘আ করি, তিনি যেন তার হায়াতে বরকত দান করেন এবং দীনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তা যেন কবুল করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে