প্রশ্ন-১৮ : উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে উত্তম পন্থা কী? বিশেষতঃ শাসকদের উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে মঞ্চে তাদের মন্দ কাজের দুর্নাম করা নাকি গোপনে উপদেশ প্রদান করা? এ মাসআলায় সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট জানতে চাই

উত্তর : একমাত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই নিষ্পাপ। মুসলিম শাসকেরাও মানুষ হিসাবে ভুল করেন। নিঃসন্দেহে তাদের অনেক ভুল রয়েছে। তারা কেউ নিষ্পাপ নন। কিন্তু আমরা তাদের ভুলকে নিন্দার ক্ষেত্র মনে করে তাদের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিব না, এমন কি তারা যদি জুলুম-অত্যাচার ও সীমালঙ্ঘন করেন, যতক্ষণ না তারা প্রকাশ্য কুফরী করে বসে (ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের আনুগত্য করব)। যেমনটা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন।[1]

তাদের অবাধ্যতা, পাপাচারিতা, অত্যাচার থাকলেও ধৈর্যধারণের সাথে তাদের আনুগত্যে বহাল থাকতে হবে।[2] রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের ঐক্য বজায় রাখা ও মুসলিম দেশের প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে তাদের ব্যাপারে এমনটিই নির্দেশ দিয়েছেন।[3]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কল্যাণকামিতাই দীন, কল্যাণকামিতাই দীন, কল্যাণকামিতাই দীন। আমরা (ছাহাবীগণ) বললাম: হে আল্লাহর রসূল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কার জন্য? তিনি  রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রসূলের জন্য, মুসলিম নেতাদের জন্য এবং সকল মুসলিমের জন্য।[4] অন্য এক হাদীছে এসেছে,

إن الله يرضى لكم ثلاثًا : أن تعبدوه ولا تشركوا به شيئًا، وأن تعتصموا بحبل الله جميعًا ولا تفرقوا، وأن تناصحوا من ولاه الله أمركم

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি কাজে সন্তুষ্ট হন: তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। সবাই একত্রে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরবে, বিচ্ছিন্ন হবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর যাদেরকে শাসক নিযুক্ত করবে তাদের কল্যাণ কামনা করবে।[5]

শাসকদেরকে উপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম হলো আলিমগণের নাছিহাহ প্রদান করা, উপদেষ্টাগণের উপদেশ প্রদান করা, আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ এর নাছিহাহ প্রদান করা। আল্লাহ তাআ‘লা বলেন,

وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُم

আর যখন তাদের কাছে শান্তি কিংবা ভীতিজনক কোনো বিষয় আসে, তখন তারা তা প্রচার করে। আর যদি তারা সেটি রসূলের কাছে এবং তাদের কর্তৃত্বের অধিকারীদের কাছে পৌঁছে দিত, তাহলে অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা তা উদ্ভাবন করে তারা তা জানত। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তার রহমত না হতো, তবে অবশ্যই অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে। (সূরা আন নিসা ০৪ : ৮৩)

সুতরাং প্রত্যেকেই একাজের যোগ্য নয়। আর প্রকাশ ও নিন্দা করার দ্বারা নছীহত প্রদানের সামান্যতম কাজও হয় না। বরং এর দ্বারা ঈমানদারদের মাঝে অন্যায়-অশ্লীল কাজের প্রচলন হয়। এটা সালাফে সালেহীনের মানহাজ (কর্মপদ্ধতি) নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য যতই ভালো হোক না কেন। তার মতে অন্যায়কে অপছন্দ করা হোক না কেন। বরং তার কাজটাই ঐ গর্হিত কাজ থেকেও মারাত্মক। যদি বিরোধিতাকারীর বিরোধিতা আল্লাহ তা‘আলা ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদত্ত পন্থা ব্যতিরেকে অন্য কোনো পন্থায় বিরোধিতা করে তাহলে তাও গর্হিত বলে গণ্য হয়।[6]

قال - عليه الصلاة والسلام - : من رأى منكم منكرًا فليغيره بيده؛ فإن لم يستطع فبلسانه؛ فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে তাহলে সে যেন হাত দ্বারা বাধা দেয় (প্রতিরোধ করে), যদি এতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন যবান দ্বারা বাধা দেয় (প্রতিবাদ করে), যদি এতেও সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দ্বারা ঘৃণা করে; এটা হলো ঈমানের সর্বনিমণ স্তর।[7]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব জাতিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন।

১ম ভাগ : যারা অন্যায়কে হাত দ্বারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তারা হলো ক্ষমতাবান অর্থাৎ শাসক অথবা প্রতিনিধি, বিভিন্ন বোর্ড এবং নেতাগণ।

২য় ভাগ : আলিম, যার নিকট শাসন-ক্ষমতা নেই। তিনি বয়ান-বক্তব্য, নছিহাহ-উপদেশ, প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশ প্রদান ও বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ক্ষমতাবানদের প্রতিবাদ করবেন।

৩য় ভাগ : যার ইলম, ক্ষমতা কিছুই নেই। সে অন্তর দ্বারা অশ্লীল কাজ ও সেগুলো সম্পাদনকারীকে ঘৃণা করবে, তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।


[1]. মুসলিম শাসকের ব্যাপারে এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা। আক্বীদাতুত ত্বহাবী গ্রন্থকার বলেন, (পৃ ৩৭৯) আমরা আমাদের নেতা ও শাসকদের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়ার মত পোষণ করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অবাধ্যতার বিষয়ে আদেশ প্রদান না করেন। যদিও তারা জুলুম নির্যাতন করেন না কেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করব না এবং তাদের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিব না। আমরা তাদের আনুগত্য করাকে আল্লাহর আনুগত্যের মত ফরয মনে করি এবং আমরা তাদের সংশোধন ও ক্ষমার জন্য দু‘আ করি। হকের প্রতি আহবানকারীগণ বর্তমান কাল পর্যন্ত এ মতের উপরই রয়েছে। শ্রদ্ধেয় শায়খ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রহ.) তার বিভিন্ন পাঠ ও বক্তৃতায় বার বার এ কথা বলেছেন। তার ‘‘আল মা‘লুম মিন ওয়াজিবিল আলাক্বাতি হাকিমি ওয়াল মাহকুম ও নাছবীহাতুল উম্মাহ ফি জাওয়াচি আশারাত আসইলাহ মুহিম্মাহ’’ আরো দেখুন আব্দুল আযীয আল আসকার কর্তৃক লিখিত কিতাবে শায়খের লেখা ভূমিকায়। এমনিভাবে ‘‘মাজাল্লাতুল বহুছ আল-ইসলামিয়্যাহ এর ৫০ সংখ্যায় এ বিষয়ে শায়খের একটি প্রবন্ধ রয়েছে। এবইগুলো তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলিল যারা বলে যে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি বা রচনা করেননি। তাদের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

[2]. ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে লোক নিজ আমীরের কাছ থেকে অপছন্দনীয় কিছু দেখবে সে যেন তাতে ধৈর্য ধারণ করে। কেননা যে লোক জামাত হতে এক বিঘতও বিচ্ছিন্ন হবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু। (বুখারী হা/৭০৫৪)।

অপর হাদীছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার পরে তোমরা অবশ্যই ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করবে। এমন কিছু বিষয় দেখবে যা তোমরা পছন্দ করবে না। তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য কি আদেশ করছেন? উত্তরে তিনি বললেন, তাদের হক পূর্ণরূপে আদায় করবে, আর তোমাদের হক আল্লাহর কাছে চাইবে। (সহীহ বুখারী হা/৭০৫২, তিরমিযী হা/২১৯০)।

[3]. এখানে সম্মানিত শায়খ হাফিযাহুল্লাহ উবাদাহ ইবনে সমিত থেকে বর্ণিত ঐ হাদিসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে হাদিসে তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আহবান করলেন আমরা তার নিকট এ মর্মে বায়‘য়াত গ্রহণ করলাম যে আমাদের সুদিন-দুর্দিন, খুশি-দুঃখ সর্বাবস্থায় শ্রবণ করব ও আনুগত্য করব, ভলো কাজ সম্পাদন করব এবং শাসকদের সাথে দ্বিমত করব না। তবে তোমরা যদি  তাদের মাঝে প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পাও যে বিষয়ে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলিল আছে (সে বিষয়ে দ্বিমত করা যাবে)। (আল ফাতহ ৫/১৩)

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহিমল্লাহ এর সাথে যোগ করেন ‘‘ যদিও তুমি মনে কর যে তুমি সত্যেও উপর রয়েছ তবুও তুমি ঔ ধারনার উপর আমল করো না। বরং শ্রবণ এবং আনুগত্য করতে থাকো তোমার নিকট সত্য পৌঁছা পর্যন্ত। ইবনে হিববাহ ও ইমাম আহম্মাদ আরো যোগ করেন যদিও তারা তোমার সম্পদ ভক্ষণ করে এবং তোমার পিঠে প্রহার করে। আল ফাতহ ৮/১৩।

[4]. সহীহ মুসলিম হা/৫৫

[5]. সহীহ, মুয়াত্তা ২/৭৫৬, আহমাদ ২/৩৬৭ এর মূলকথা সহীহ মুসলিমে হা/১৭১৫।

[6]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমীয়া (রহ.) বলেন, ‘‘সৎ কাজের আদেশ প্রদান এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদানের মাধ্যম হলো নম্রতা। এজন্য বলা হয়,  ‘তোমার সৎ কাজের আদেশ যেন সৎ পন্থায় হয় এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান যেন অসৎ পন্থায় না হয়। যেহেতু সৎকাজের আদেশ প্রদান করা এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করা ওয়াজিব ও অন্যতম পছন্দনীয় কাজ। সুতরাং এর উপকারিতা অবশ্যই অনিষ্টের উপর প্রাধান্য পাবে। বরং আল্লাহ তা‘আলা যা কিছুর নির্দেশ প্রদান করেছেন সেগুলোই সৎকর্ম।

আল্লাহ সৎকর্ম ও তার সম্পাদনকারীর প্রশংসা করেছেন এবং অনেক স্থানে বিশৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলাকারীর নিন্দা করেছেন। আল্লাহর নির্দেশিত পন্থা ছাড়া অন্য কোন পন্থায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা প্রদান কতই না মারাত্মক (হতে পারে)। আর যদি এর দ্বারা ওয়াজিব পরিত্যাগ করে এবং হারাম কাজ করে বসে?

মুমিন বান্দার উপর আবশ্যক হলো: সে আল্লাহর বান্দাদের অধিকারের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করবে। মানুষকে হিদায়াত প্রদান করার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত নয়। (‘‘আল আমরু বিল মা‘রুফ ওয়া আন নাহয়ু আনিল মুনকার’’ পৃ. ১৯)

[7]. সহীহ মুসলিম হা/৪৯।