মনে মনে কাউকে ভালো লেগে যাওয়া, কাউকে ভালোবেসে ফেলা, কারো প্রতি প্রেম হয়ে যাওয়া কোন দোষের কিছু নয়। কারণ, এ হল মনের ব্যাপার। আর মন যদি পবিত্র ও নির্মল থাকে তবে পাপেরও ভয় থাকে না তখন।

পবিত্র প্রেম হল অন্তঃসলিলা ফগু নদীর মত, যা নিঃশব্দে ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশে লুকিয়ে বইতে থাকে, কিন্তু উদ্ধৃঙ্খল হতে পায় না। পবিত্র প্রেম সেই প্রেমকে বলে, যার মাঝে থাকে না কোন প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা, থাকে না কপটতা ও কামচরিতার্থ করার লালসা ও বাসনা। পবিত্র প্রেম হল পবিত্র হৃদয়ের সেই ভালোবাসা ও আকর্ষণের নাম, যা হৃদয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। (বিবাহের পূর্বেই) প্রেম হৃদয়ের বাইরে বের হয়ে এলেই অপবিত্র হয়ে যায়। দর্শন, আলাপন, পত্রালাপ, দুরালাপ, স্পর্শ প্রভৃতির আবর্জনা মিশেই প্রেম কলুষিত ও কলঙ্কিত হয়। পরন্তু বিবাহ এ সব থেকে পবিত্র করে প্রেমকে নির্মল করে দেয়। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, লোকেরা স্ত্রীর সাথে হালাল প্রেমকে ‘প্রেম’ মনে করে না, ভাবে সেটা কোন বাপুত্তি অধিকার।

পক্ষান্তরে অপবিত্র ও অস্বাভাবিক প্রেমকেই লোকেরা ভালোবাসা’ নামে অভিহিত করে থাকে। প্রেম হয়ে যাওয়াটা মানুষের প্রকৃতিগত ব্যাপার এবং তা তার নির্মল ও সুকোমল হৃদয়েরই পরিচায়ক। কিন্তু প্রেম করাটা হল খারাপ। অর্থাৎ, প্রেমের অভিনয় করে কাউকে ধোকা। দেওয়া অথবা অবৈধভাবে প্রেমের বিভিন্ন মঞ্জিল অতিক্রম করা ভালো মানুষের কাজ নয়। যেমন ভালো নয় কারো প্রেমের জেলে বন্দী হয়ে পড়া, অতিরঞ্জিতভাবে প্রেমের পূজা করা। আসলে হৃদয়ের প্রেমকে যে নিয়ন্ত্রণে রেখে যথার্থরূপে বৈধভাবে যথাস্থানে প্রয়োগ করতে পারে, সেই হল জ্ঞানী মানুষ। যেমন ভালো নয় শুষ্ক হৃদয়, তেমনি উদ্ধৃঙ্খল মানসিকতাও ভালোর পরিচয় নয়।

পবিত্র প্রেমের সাথে কামনার কোন সম্পর্ক নেই। প্রেম ও কামনা হল সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন। আর কামনা হচ্ছে সাময়িক উত্তেজনা।

পবিত্র প্রেমের প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমকে পবিত্র ও চিরন্তন রাখার জন্য বৈধ পথ ব্যবহার করে যাও। জেনে রেখো, কাউকে পছন্দ হওয়ার আগে, কোন কিছুকে পছন্দ করার পূর্বে, তোমার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পছন্দ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার পথ বের করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হবেন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রা স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাকৃ ২-৩ আয়াত) “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (ঐ ৪ আয়াত) অতএব এক আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভরসা রেখে তোমার পবিত্র প্রেমকে পবিত্র রেশমী রুমালের মত হৃদয়েই বেঁধে রেখো এবং পবিত্র অবস্থাতেই সেখান হতে খুলে নেওয়ার চেষ্টা।

করো। আর তার দরবার ছেড়ে প্রেমে সাফল্য লাভ করার জন্য কোন সৃষ্টির দরবারে গিয়ে আরো জঘন্য অপবিত্রতা শির্কে পড়ে যেও না। অর্থাৎ, তাকে পাওয়ার জন্য কোন তাবীয়ব্যবসায়ীর কাছে শিকী তাবীয নিতে খবরদার যেও না। যোগ-যাদু করে তাকে বশীভূত করার উদ্দেশ্যে কোন যাদুকরের প্রতি পা বাড়াও না, কোন দর্গা বা মাযারে গিয়ে প্রেম অনির্বাণ রাখার আবেদন জানিয়ে মানত মেনে বা ধুল-ফুল’ খেয়ে এস না। এ রকম করলে তুমি সব চাইতে বেশী অপবিত্র ও নীচ হয়ে যাবে।

পবিত্র প্রেমকে গোপনে অতিরঞ্জিত করে নিজেকে ধ্বংস করো না এবং এ কথা ভেবো না যে, “যে ব্যক্তি প্রেম করে এবং হারামে পতিত না হয়ে পবিত্র অবস্থায় মারা যায়, সে শহীদ।” এ। কথা লায়লা-মজনু ও শিল্পী-ফরহাদ’ জগতের বহু মানুষের নিকটেই প্রচলিত থাকলেও এবং অনেকে তা ‘হাদীস’ বলে জানলেও, আসলে তা কিন্তু প্রেমবাজদের দ্বীনের নবীর নামে মিথ্যা রচনা। (সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৪০৯ নং)

তবে হ্যা, প্রেম হয়ে যাওয়ার পর যদি কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে সবর করে এবং প্রেমিকার প্রতি দৃকপাত করে না ও তার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করে না। বরং আল্লাহর ভয়ে পবিত্রতা বজায় রাখে এবং তার নিকটবর্তী হওয়ারও চেষ্টা করে না। অথচ ইচ্ছা করলে সে এ সব কিছুই অনায়াসে করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তার মনের সকল আশা-আকাঙ্খকে গোপনে দমন করে রাখে এবং আল্লাহর প্রেম, ভয় ও সন্তুষ্টিকে এ সবের উপর অগ্রাধিকার দান করে, তাহলে সে আল্লাহ তাআলার এই প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত হওয়ার আশা রাখতে পারে, যে প্রতিশ্রুতির কথা তিনি কুরআন মাজীদে বলেন, “যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং খেয়াল-খুশী হতে মনকে বিরত রাখে, অবশ্যই জান্নাত হবে। তার আশ্রয়স্থল।” (সূরা নাযিআত ৪০-৪১ আয়াত) “আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হতে হবে -এই ভয় রাখে এবং সেই ভয়ে সকল পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে) তার জন্য রয়েছে দু’টি বেহেশু।” (সূরা রাহমান ৪৬ আয়াত)

এ ছাড়া শহীদ’ হল আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত এক বিরাট মর্যাদা। সে মর্যাদা তার সন্তুষ্টির পথে নিজের জানকে কুরবানী দিলে তবেই লাভ হয়। নিজের কামনা-বাসনা ও মনের খেয়াল-খুশীর তাবেদারী করে একজন সুন্দরী লাভের পথে জীবন দিলে সে মর্যাদা অবশ্যই পাওয়া যায় না। তদনুরূপ বহু প্রেমবাজ ধৃষ্টরা এ কাজে আল্লাহর মনোনীত নবীদেরকেও শামিল করে নিজেদের দল ভারী করে ফেলেছে! আল্লাহর কুরআনকেও মিথ্যা বানিয়ে তারা গেয়েছে,

‘প্রেমের মড়া জলে ডোবে না

প্রেম করেছে ইউসুফ নবী,

তার প্রেমে জোলেখা বিবি গো---

এ বলে তারা তাদের কাজ যে খারাপ নয়, তা প্রমাণ করার মানসে সীমাহীন দৃষ্টতা প্রকাশ করেছে।

যেমন হযরত ঈসা (আঃ) এর সাধী মাতা মারয়্যামকেও তুলনা করা হয়েছে বারাঙ্গনার সাথে! কবি বলেন,

‘অহল্যা যদি মুক্তি লভে মা, মেরী হতে পারে দেবী,

তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি?!

পাপী বানানো হয়েছে নির্বিচারে সকলকে। এ জন্য বলা হয়েছে,

এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনিক কে আছে পুরুষ নারী,

আমরা তো ছার, পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী!

---আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে,

কম-বেশী করে পাপের ছুরীতে পুণ্যে করেছে জবেহ!’

অথচ এ কথা অন্যান্য ধর্মের দেবতাদের ক্ষেত্রে সত্য হলেও সত্যের কান্ডারী নবীগণের ক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যা। সুতরাং কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করার পূর্বে বিবেচনা করে দেখা জরুরী যে, যাকে চাবুক লাগাচ্ছি, আদৌ সে চাবুক খাওয়ার যোগ্য কি না? শুধু নবীই নয়, বরং আল্লাহর ফিরিস্তাদেরকেও ছাড়া হয়নি এ ব্যাপারে! কবি বলেছেন,

--দু’দিনে আতশী (?) ফেরেস্তা প্রাণ ভিজিল মাটির রসে,

শফরী চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে।

ঘাঘরী ঝলকি’ গাগরী ছলকি’ নাগরী জোহরা যায়

স্বর্গের দূত মজিল সে রূপে, বিকাইল রাঙা পায়!

অধর আনার রসে ডুবে গেল দোজখের মার ভীতি,

মাটির সোরাহী মস্তানা হল আঙ্গুরি খুনে তিতি!

কোথা ভেসে গেল সংযম বাধ, বারণের বেড়া টুটে,

প্রাণ ভরে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ পুষ্প পুটে!!

এ ধরনের বহু মজার গল্প শুনিয়ে ঐ শ্রেণীর তথাকথিত মানবতাবাদী নৈতিকতার শত্রুরা নিজেদের পাপকে সুশোভিত করার জন্য বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে।

মহান আল্লাহ বলেন, “যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে তুমি অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় -ওদের প্রত্যেকটিকে (কাল কিয়ামতে) কৈফিয়ত দিতে হবে।” (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)