নজরবাজির বাজিতে হেরে গেলে যুবকের মনের নিভৃত কোণে গোপন প্রেম সৃষ্টি হয়ে যায়। জেগে ওঠে কত কল্পনা, কত বাসনা। পুনরায় সাক্ষাতের আশা মনকে অতিষ্ঠ ও অধীর করে। তোলে। রাতের অন্ধকারে যেন কাটার বিছানায় শয়ন করে অনিদ্রায় কল্পনার জগতে বিচরণ করে। দেখা ছবি মানসপটে ভেসে উঠলে তাতালো পাত্রে পানি পড়ার মত মনটা ছ্যাক’ করে। ওঠে। প্রেম-সমুদ্রের তরঙ্গমালা রিক্ত বক্ষকে প্রবল বেগে আঘাতের পর আঘাত দিতে থাকে। প্রণয়ের কচি-কিশলয় যেন মনের মাটি ছেড়ে কামনার মুক্ত আকাশে দোলা দেয়। শয়নেস্বপনে-নিশি জাগরণে ভালোবাসার আবেগভরা কত কবিতা স্মৃতির মানসপটে জেগে ওঠে। গোপন প্রিয়ার উদ্দেশ্যে মন গেয়ে ওঠেঃ

‘বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি

ঝরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী?

মনের মনে নিশীথ-রাতে

চুম দেবে কি কল্পনাতে?

স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি!

মেঘের সাথে কাদবে তুমি, আমার চাতকী!

--- বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের সাথী নও,

দুরে যত রও এহিয়ার তত নিকট হও!

থাকবে তুমি ছায়ার সাথে

মায়ার মত চাঁদনী রাতে।

যত গোপন তত মধুর - নাইবা কথা কও?

শয়ন-সাথে রও না তুমি, নয়ন পাতে রও।

ওগো আমার আড়াল-থাকা, ওগো স্বপন-চোর!

তুমি আছ, আমি আছি এই তো খুশী মোর।

কোথায় আছ কেমনে রাণী,

কাজ কি খোজে, নাই বা জানি!

ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর।

চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!

রাতে যখন একলা শোব চাইবে তোমায় বুক,

নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ।

দুখের সূরায় মস্ত হয়ে।

থাকবে এ প্রাণ তোমায় লয়ে,

কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ!

ঘুমে জাগায় জড়িয়ে রবে, সেই তো চরম সুখ!

এইভাবে যত দিন যায়, গোপন প্রিয়ার প্রতি দর্শন-তৃষ্ণা তত বেড়ে ওঠে। সাক্ষাতের বাসনা তীব্র হয়। কিন্তু বাধা পড়ে সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতার সজাগ দৃষ্টি। ফলে বেড়ে ওঠে বেদনা। আর রাত্রি যত গভীর হয়, প্রভাত তত এগিয়ে আসে। বেদনা যত নিবিড় হয়ে আসে, প্রেম তত কাছে আসে। প্রেমে যত বাধা পড়ে, প্রেম তত বেড়ে চলে। মনের বাসনা, কল্পনা ও সেই সাথে বাধার ফলে মনের চাঞ্চল্য আরো বৃদ্ধি পায়। মন চায় প্রেমের কথা প্রেমিকার কাছে ফুটে বলতে। সরাসরি সে সুযোগ না থাকলে কলম দ্বারা সে নিবেদন ও আবেগ পৌঁছে দেওয়া হয়।

একলা রাতে শুয়ে থাকি

স্বপনে তোমারে দেখি।

বালিশ ভিজে চোখের জলে

বিছান ভিজে ঘামেতে,

যারে যা চিঠি লেইখা দিলাম

সোনার বন্ধুর নামেতে---!!!

মন তখন কলমের মুখে কাগজের সাথে ভালোবাসার কত কথা বলে। কত কথা ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে না বলা থেকে যায়।

কলমে নাই কালি হাতে নাই জোর,

পত্র লিখতে বসে আমার রাত্রি হল ভোর!

প্রীতির সাথে ইতি দিয়ে শেষ করলাম লেখা,

জানি না যে, তোমার সাথে কবে হবে দেখা!

কখনো বা কথা হয় মনে-মনে, গোপনে, কানে-কানে, ফোনে-ফোনে। প্রেম এমনই জিনিস যে, মনের গোপন কোণে তা ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। প্রেম যোগায় কল্পনা। ভালোমন্দের কল্পনা। আশা ও আশঙ্কার, ভয় ও ভরসার কত শত সুদূর কল্পনা। আর কল্পনা আনে চিন্তাশক্তি ও সাহিত্যিক রচনা-শৈলিতা। প্রেম আনে জীবনের আন্দোলন, আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার। সান্নিধ্যের আশা এবং দূরত্বের হতাশ তথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কার সুখ ও কষ্ট মানুষের মনে কবিত্ব সৃষ্টি করে।

নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,

যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

মন তখন শুধু গেয়ে ওঠে ভালোবাসার গান, মিলনের গান, বিরহের গান।

‘তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি,

তোমার এ রূপ-সে তো তোমার ভালোবাসার ছবি!

প্রেম যেমন দুই প্রকার; পবিত্র ও অপবিত্র। ঠিক কবিত্বও দুই প্রকার; বৈধ ও অবৈধ। আকাশ-কুসুম অবাস্তব কল্পনা করে আবোল-তাবোল বা অশ্লীল কথামালার কবিতার কবি সাধারণতঃ অপবিত্র প্রেমের প্রেমিকই হয়ে থাকে। আর এ শ্রেণীর কবির মন যখনই কবিতা লিখতে নির্জনে বসে, তখনই শয়তান তার সঙ্গী হয়ে কবির কল্পনায় সহযোগিতা করে। (সহীহুল জামে ৫৭০৬ নং)।

এ শ্রেণীর কবি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে থাকে। তুমি কি দেখ না যে, ওরা প্রত্যেক উপত্যকায় (লক্ষ্যহীনভাবে সর্ববিষয়ে) কল্পনাবিহার করে? এবং ওরা যা বলে, তা করে না।” (সূরা শুআরা ২২৪-২২৬ আয়াত)

এ শ্রেণীর কবি কখনো তাওহীদ ও ইসলামের প্রশংসা ও জয়গান গাইলেও শির্ক ও কুফরী তথা বিদআতের প্রশংসা এবং জয়গান গেয়ে থাকে। কখনো বীরত্বের কথা, কখনো নারীপ্রেমের কথা, কখনো সতীত্বের নিন্দা, আবার কখনো বেশ্যার প্রশংসা, এবং এইভাবে জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে কবিতা রচনা করে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতায় যা বলে, মনে তা বিশ্বাস রাখে না। যতটা বলে, বাস্তব ততটা নয় বা মোটেই নয়। যা বলে, তা নিজে করে না।

প্রেমজালে আবদ্ধ কবি বন্ধু আমার! তোমার প্রেম যদি পবিত্র হয়, তাহলে সে কথা ভিন্ন। তোমার কবিতার শব্দ-ছন্দ যদি কল্পনা-প্রসূত অবাস্তব না হয়, অতিরঞ্জিত, অশ্লীল ও নৈতিকতা-বিরোধী না হয়, বরং বাস্তবধর্মী ও সত্যের আহ্বায়ক হয়, বাতিলকে খন্ডন করার জন্য হয়, তাহলে অবশ্যই তা প্রশংসনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, “তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করে, আল্লাহকে খুব স্মরণ করে এবং অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়?” (ঐ ২২৭ আয়াত)

প্রেমিক বন্ধু আমার। তুমি হয়তো ভাবতেও পার যে, তোমার প্রেম পবিত্র। কিন্তু জেনে রেখো যে, মানুষের মন বড় মন্দপ্রবণ। যেটা করতে নিষিদ্ধ, সেটা করেই যেন মানুষের আনন্দ বেশী। আর যেটা নিয়ে মানুষ আনন্দে মত্ত ও উদাস হতে পারে, সেটাই দ্বীনে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি অনুরাগ, আকর্ষণ ও কৌতুহল মানুষের প্রকৃতি। বলা বাহুল্য, এখানেই থাকে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের আসল পরীক্ষা। যে বই-এর উপর লেখা থাকে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পড়া নিষেধ’ সে বইটাই অপ্রাপ্তবয়স্করা আগে পড়ার চেষ্টা করে। নচেৎ যেন, শান্তি পায় না, স্বস্তি পায় না। অধিকাংশ মানুষেরই মনের প্রবণতা ঠিক পাগলার মত; যখন পাগলাকে বলা হল, ‘পাগলা সঁকো নাড়ি নে! পাগলা বলল, মনে ছিল না, ভালো, মনে করে দিলি। আর এই বলে সে অর্ধভগ্ন বাঁশের সাঁকো নেড়ে ভেঙ্গেই ফেলল।

এমনই ঘটে থাকে। যার যাতে আনন্দ, তাকে সে কাজ করতে নিষেধ করলে অনেক সময় তার সেই প্রবৃত্তি অধিকতর প্রবল হয়ে ওঠে। পরন্তু যার যে কাজে প্রবৃত্তি, তাকে সেই কাজে নিষেধ করতে গিয়ে দেখা যায় যে, তার সে প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে, যা সে ভুলে ছিল।

আশা করি যে, তুমি সে প্রকৃতির নও। কারণ, তোমাকে মনে রাখতে হবে যে, “বেহেস্তের পথ বড় কঁাটাময় এবং দোযখের পথ বড় আনন্দময়।” (বুখারী মুসলিম আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে’ ৩ ১২৬, ৩১৪৭ নং) আর সে আনন্দের কি কোন মূল্য আছে, যার পশ্চাতে অপেক্ষা করে দুঃখ ও কষ্ট? কিন্তু মনের উপর তোমার যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলেই সর্বনাশ! পরন্তু আকাঙ্খার ধন যত দুর্লভ হয়, মনের আকাঙ্খা তত বাড়ে। আর ভোগ যেমনই হোক, তার একটা তীব্র নেশা আছে। একপাত্র নিঃশেষ করে অবিলম্বে আর এক পাত্রের দিকে হাত বাড়াতে ইচ্ছা হয়।

মন্দপ্রবণ মন যত ভোগ করে, তার ভোগের বাসনা ততই বেড়ে চলে। তুমি যদি কারুনের সমান ধন-মাল পাও, ফেরাউনের মত সস্বাস্থ্য ও দেহ পাও এবং সর্বপ্রকার রঙ, রূপ ও লাবণ্যের দশ হাজার উদ্ভিন্ন-যৌবনা সুন্দরী যুবতী শয্যা-সঙ্গিনীরূপে পাও, তবুও তুমি কি মনে কর যে, এতে তোমার মন-জান ভরবে? কক্ষনো না। অবৈধ পথে বগাহীন মনের প্রবৃত্তি ও প্রবণতাই হল এমনি। পক্ষান্তরে হালাল পথের একটি নারীই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। মনের সকল চাহিদা তারই মাঝে মিটে যাবে; যদি তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে। নচেৎ অবৈধ প্রণয় ও কামনার জ্বালা তোমার মনকে কোনদিন শান্তি দিতে পারবে না।

কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,

প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।

জন্ম যার কামনার বীজে

কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।

দিকে দিকে পাখা তার করে অভিযান,

ও যে শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।

আকাশ ঢেকেছে তার পাখা

কামনার সবুজ বলাকা!

প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু অগণন,

তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।