মানুষ তার প্রকৃতিগত সৃষ্টিবৈচিত্রে পর্যায়ক্রমে যে সব জীবন লাভ করে থাকে তন্মধ্যে শৈশব ও কৈশর জীবনটাই সব চাইতে নির্মল ও বিঘ্নহীন। শিশুকিশোর মনে পিতা-মাতার স্নেহাশিস্ সুখের ঢেউ তোলে। পিতামাতার সর্বপ্রকার সুখ ও সমৃদ্ধিই তার হৃদয়-কুসুমকে দোলা দেয়। এ সময়কার সকল ভূত-ভবিষ্যৎ ন্যস্ত থাকে অভিভাবকের উপর।

অবশ্য এর পরবর্তী জীবনই হল বড় মধুর, বড় তিক্ত, বড় সুখময়, বড় জ্বালাময়। বড় কোমল, বড় কঠিন। বড় চাঞ্চল্যময়, বড় চিন্তাময়। এ পর্যায়ে এসে তরুণ মন সকল প্রকার, শৃঙ্খল এড়াতে চায়। ছিন্ন করতে চায় সকল বন্ধন। যৌবনের উন্মাদনার ঐ পাগলা ঘোড়া উল্লংঘন করতে চায় সকল বাধা-বিপত্তিকে। ছন্নছাড়া বাধন হারা হয়ে বিচরণ করতে চায়। লাগামহীন প্রবৃত্তির প্রবণতা। হাওয়ার তালে তালে দুলে ওঠা সমুদ্রের তরঙ্গমালার মত, ঝড়ো হাওয়ার ক্ষিপ্র গতির মত, বাদলা মেঘের পাগলা বারিপাতের মত, সুউচ্চ পর্বতের বাধাহীন জলপ্রপাতের মত বুকে এসে প্রতিহত হয় তারুণ্যের মনোবল, যৌবনের যৌনজ্বালা, তাজা শক্তির শৌর্য ও বীর্য।

‘তুমি কে? তুমি মদোন্মত্ত মানবের যৌবন,

তুমি বারিদের ধারা জল মহাগিরির প্রস্রবণ।

জীবনের এই পর্যায়ে বগাহীন পাগলা ঘোড়ার লাগাম জরুরী। এমন কুলকুল তান নদীর দুকুলে বাধ হওয়া আবশ্যিক। যৌবনের এ চাঞ্চল্যময় ক্ষিপ্র গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই দরকার। তা না হলে বিপদ অনিবার্য। পরিণাম বড় মন্দ।

মানুষের মন বড় মন্দপ্রবণ হলেও বৃদ্ধের তুলনায় যুবকের মন বড়ই সরল। বৃদ্ধের মনে যে কট্টর মনোভাব ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকে তা দুর করা ততটা সহজ নয়, যতটা সহজ। একজন যুবকের মন থেকে তা দূর করা। সুতরাং জীবনের এ পর্যায়ে যুবক যে তরবিয়তী বিশেষ তালীম পাওয়ার যোগ্য তা বলাই বাহুল্য। যদিও এ উদ্ধৃঙ্খলতার যুগে এ কাজ ততটা সহজ নয়। মেনে নেওয়া ও মানানো উভয় কাজের ক্ষেত্রেই পরিবেশ আমাদের প্রতিকূলে। তবুও মানতে হবে, মানাতে চেষ্টা করতে হবে। হেদায়াত আল্লাহর হাতে। আর সহজ নয় বলেই কিয়ামতের সে ছায়াহীন প্রখর রৌদ্রতপ্ত প্রান্তরে এমন যুবক আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে, যে তার ঐ যৌবনকালকে আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। সত্যই তো, যে রাজপথে চলে সে তার মত নয়, যে দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ লংঘন করে উদ্দিষ্ট পথে অগ্রসর হয়।

অবশ্য সংস্কার ও সংশোধনের পথে যেমন যুবগোষ্ঠীর নিজস্ব মন ও ঐকান্তিক আগ্রহ থাকা দরকার, ঠিক তেমনি আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা দরকার বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ সমাজের। নচেৎ মসজিদের ইমাম যুবক হলে যদি বৃদ্ধরা দুরে দুরে থাকে এবং বৃদ্ধ হলে যুবকদল তার কাছ না ঘেসে, তাহলে অভীষ্ট ফল যে লাভ হবে না তা বলাই বাহুল্য। সমাজে বিভিন্নমুখী অবনতি ও অজ্ঞানতার অন্যতম মৌলিক কারণ হল, যুবক ও বৃদ্ধদের মাঝে ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে এককে অপরের মজলিসে বসতে দেখা যায় না।

বয়োজ্যেষ্ঠরা যুবকদের পাপাচরণ দেখেও যেন হতবাক ও অক্ষম সেজে তাদেরকে তাতে বাধা দিতে সাহস করে না। তরুণদের সদাচরণ ও সংশোধনের ব্যাপারে তারা নৈরাশ্য প্রকাশ করে। যার ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধের মাঝে যুবকদের প্রতি কেমন এক প্রকার বিদ্বেষ, বিরাগ ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় এবং যুবক চাহে ভালো হোক অথবা মন্দ তার প্রতি কোনও ক্ষেপও করে না। কখনো বা একটি যুবকের অসদাচরণ দেখে সমগ্র যুব-সমাজের উপর একই কুধারণা রেখে থাকে। ফলে প্রত্যেক যুবক ও তরণের প্রতি তার মন ভেঙ্গে যায়। যার কারণে সমাজ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যুবক ও বৃদ্ধ একে অপরকে অবজ্ঞা, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা ও অস্নেহ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আর এই মহা আপদ তখন গোটা সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু এই ব্যাধির প্রতিকার করতে যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকেই সেই চেষ্টা রাখা উচিত, যাতে তাদের আপোসের উক্ত ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা দূরীভূত হয়।

আর সকলেই যেন এই বিশ্বাস রাখে যে, যুবক ও বৃদ্ধের মিলিত প্রচেষ্টায় গঠিত সমাজ একটি মাত্র দেহের ন্যায়; যার কোন এক অঙ্গ বিকল হলে সারা দেহ বিকল হয়ে যেতে পারে। যেমন বৃদ্ধদের উচিত, যুবকদের ব্যাপারে তাদের কর্তব্য ও স্কন্ধে অর্পিত ভার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং যুবকদের সদাচরণের ব্যাপারে তাদের হৃদয়ে ঘনীভূত নৈরাশ্যকে দূর করা। যেহেতু আল্লাহ তাআলা সকল বস্তুর উপর সর্বশক্তিমান। কত পথভ্রষ্টকে তিনি সুপথপ্রাপ্ত করেছেন। যারা অপরের জন্য সুপথের দিশারী ও সমাজ সংস্কারক রূপে পরিচিত হয়েছে। যুবকদেরও কর্তব্য, যেন তারা তাদের বৃদ্ধ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি। রাখে। তাদের মতামতকে সম্মানের চোখে দেখে, তাদের নির্দেশনা সাদরে গ্রহণ করে। যেহেতু বৃদ্ধরা দীর্ঘ জীবনের বহু ঘটনাঘটনের মাধ্যমে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে; যা যুবকরা করতে পারেনা। অতএব যদি নবীনদের উদ্যম ও শক্তির সাথে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও হিকমত সংযুক্ত ও মিলিত হয় তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সমাজ সাফল্য ও মর্যাদা লাভ করবে। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ১৬-১৭পৃঃ)

তরুণ ও যুবকদল সমাজের শক্তি ও বাহুবল। তরণের উপরেই সন্নিবিষ্ট থাকে সমাজের বহু আশা, আকাঙ্খা ও ভরসা। যে কোন জাতিই তার যুবগোষ্ঠীকে নিয়েই গর্ব করে থাকে। জাতির অমূল্য সম্পদ তার যুবশক্তি। অতএব এমন সম্পদের অপচয় হতে দেওয়া কোন জাতিরই উচিত নয়। তাই বিশেষ করে এ অমূল্য সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় দ্বীনের আহ্বায়ক ও সংস্কারকদের উপরে। উলামা সমাজ যুবশক্তির ব্যাপারে যত্নবান না হলে, সে শক্তির যে অপচয় ও অপব্যবহার হয়, বর্তমান জাতির অবস্থাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সমাজ গঠনের প্রাথমিক স্তর থেকেই যুবগোষ্ঠী ও তার চিন্তাধারার উপর সমীক্ষা করা এবং তার মঙ্গলময় দিককে সমৃদ্ধি দান করা ও অমঙ্গলময় দিকের সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করা সমাজ সংস্কারকের সমুচিত কর্তব্য। যেহেতু আজকের কাঁচা যুবক আগামী কালের পুরুষ ও সমাজ। যুব সমাজ এমন এক ভিত্তি, যার উপর উম্মতের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠিত হয়।

তাইতো শরীয়ত যুবগোষ্ঠীর প্রতি যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যুবকের যুবাবস্থা সময়কালকে বড় মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। যেহেতু যুব সমাজ যদি সত্যের

উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উপর উম্মতের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠিত, তাহলে সমাজের প্রভূত কল্যাণের আশা করা যাবে। ঐ যুব সমাজের ধর্মনিষ্ঠা ও সুন্দর চরিত্রে উম্মতের জ্যোতির্ময় ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বর্তমানের প্রকৃত ও মুসলিম ও ওলামা সমাজের উপযুক্ত ওয়ারেস ও প্রতিনিধি হবে তারাই।

বর্তমান যুবসমাজের প্রতি যদি সমীক্ষ্য দৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে সাধারণভাবে পরিদৃষ্ট হবে যে, ঐ সমাজে তিন প্রকার যুবক রয়েছে, সত্যানুসারী ও ধর্মনিষ্ঠ, সত্য ও ধর্মত্যাগী, এবং এই দুয়ের মাঝে দোটানায় দোদুল্যমান যুবক। ধর্মনিষ্ঠ ও সত্যানুসারী যুবক, যে কলেমা তওহীদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, তার দাবী অনুসারে কাজ করে, ধর্মে প্রগাঢ় বিশ্বাসী ভক্তি ও প্রেমের সহিত আত্মসমর্পণকারী, ধর্মীয় অনুশাসনে সন্তুষ্ট, স্বধর্ম নিয়ে গর্বিত, ইসলামের অনুসরণকে যে চির কল্যাণ ও মুক্তিদাতা ভাবে এবং এই ধর্ম থেকে বহির্গত হওয়াকে যে চির ক্ষতিকর ও সর্বনাশী মনে করে। যে যুবক আল্লাহকে বিশ্বাস করে; যিনি তার ও সমগ্র আকাশ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা।

যেহেতু সে আল্লাহর বহু নিদর্শন লক্ষ্য করে; যাতে তার নিকট আল্লাহর অস্তিত্বে কোন সন্দেহ ও দ্বৈধের অবকাশ থাকে না। সুতরাং সে এই বিস্ময়কর বিশাল জগতের সৃষ্টি-বৈচিত্র এবং তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা-ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করলে তার স্রষ্টার অস্তিত্বের, তার পরিপূর্ণ বিজ্ঞান ও শক্তির। এবং তার মহা প্রকৌশলের স্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ খুঁজে পায়। কারণ, এই বিশ্ব-জাহান অযাচিতভাবে আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে যায়নি। এই বিশাল বিশ্ব এক সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অনুবর্তী। যে শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মের কোন পরিবর্তন ও বিবর্তন নেই। সারা বিশ্ব ঠিক সেই নিয়মেই চলছে, যে নিয়মে চলতে সৃষ্টিকর্তা তাকে আদেশ করেছেন। কিন্তু তুমি আল্লাহর নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানে কোন ব্যতিক্রমও দেখবে।”(কুঃ ৩৫/৪৩) “দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবেনা; সুতরাং আবার তাকিয়ে দেখ কোন ত্রুটি দেখতে পাও কিনা? অতঃপর তুমি বার বার তাকাও তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ এবং ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।” (কুঃ ৬৭/৩-৪)।

সুতরাং যদি এ বিশ্বচরাচর সুশৃঙ্খল ও সুনিপুণ ব্যবস্থাযুক্ত হয় তাহলে তা কোনক্রমেই অযাচিতভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। যেহেতু অযাচিতভাবে সৃষ্ট বস্তুর ব্যবস্থা-বিধানও অযাচিত হয়। যার ফলে যে কোন মুহূর্তে তাতে বিবর্তন ও বিশৃঙ্খলা ঘটে। যে যুবক আল্লাহর সমূদয় ফিরিশ্যাকুলের উপর ঈমান রাখে। যেহেতু কুরআন ও সুন্নায় তাদের বিভিন্ন গুণাবলী, ইবাদত ও কর্তব্যাদি সম্পর্কে বহু বিবরণ এসেছে। অতএব তাঁদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যে যুবক আল্লাহর সমূদয় রসুলের উপর এবং তার অবতীর্ণ সমূহ আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস রাখে। যেহেতু তা হল মানুষের সরল পথের দিশারী এবং এ ছাড়া মানুষ জ্ঞান, ইবাদত, অধিকার ও ব্যবহারের যাবতীয় বিস্তারিত বিষয়াবলীকে জানতে অক্ষম ছিল। যে যুবক আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত সকল আম্বিয়া ও রসুলগণের প্রতি ঈমান রাখে। যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান এবং সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যাতে তাদের আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের যেন কোন অভিযোগ না থাকে।

যে যুবক পরকালের (জান্নাত ও জাহান্নামের) অনন্ত জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। সেই হিসাবের দিন ও পুনরুত্থান-দিবস কিয়ামতকে বিশ্বাস করে; যেদিন আল্লাহ তাআলা সকলকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করবেন এবং নিজ নিজ কর্মফল প্রদান করবেন। “সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎ কাজ করলে তা সেদিন দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও সেদিন দেখতে পাবে।”(কুঃ ৯৯/৭-৮) যেহেতু সেটাই দুনিয়ার ফল। আর যদি এমন দিন সংঘটিত না হয়, যেদিন সৃষ্টি তার সৎকার্যের প্রতিদান এবং অসৎকার্যের প্রতিফল। পাবে তাহলে এ জীবনের পশ্চাতে লাভ ও যুক্তি কি? যে যুবক ভাগ্যের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান রাখে; অর্থাৎ এই বিশ্বাস রাখে যে, জগতে যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহর লিখিত নিয়তি অনুসারে ঘটে।

বান্দার হক্কে মঙ্গল-অমঙ্গল সবই তার নির্ধারিত। পরন্তু বান্দার এখতিয়ার, কর্মে হেতু ও তদবীর তথা তার প্রভাবের উপরেও বিশ্বাস রাখে এবং মানে যে, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়েরই কোন না কোন হেতু ও কারণ আছে। যে যুবক একনিষ্ঠতার সহিত কেবলমাত্র শরীক-বিহীন এক আল্লাহর উপাসনা ও ইবাদত করে। যে যুবক তার সকল প্রকার কথা ও কাজে রসূল ২ এর অনুসরণ ও অনুকরণ করে, তিনি যা আদেশ করেছেন তা নির্দ্বিধায় পালন করে এবং যা নিষেধ করেছেন তা সন্তুষ্ট চিত্তে পরিহার করে। যে যুবক যথাযথভাবে নামায পড়ে। যেহেতু সে বিশ্বাস করে যে, ঐ নামাযে ইহলৌকিক-পারলৌকিক, ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে অতিশয় মঙ্গল নিহিত আছে এবং তা পরিত্যাগ করায় ইহ-পরকালে বড় মন্দ পরিণাম আছে।

যে যুবক তার মালের যাকাত তার যথার্থ হকদারের প্রতি পূর্ণরূপে আদায় করে। কারণ, সে জানে যে, তাতে ইসলামও মুসলিমদের বহু প্রয়োজন পূর্ণ হয়। তাই যাকাত ইসলামের স্তম্ভসমূহের তৃতীয় স্তম্ভরূপে পরিগণিত হয়েছে। যে যুবক রমযান মাসের রোজা পালন করে। শীত ও গ্রীষ্মে পানাহার ও যৌন-সম্ভােগ করা থেকে দূরে থাকে। যেহেতু সে জানে যে, আল্লাহর এই আদেশ পালনে তার সন্তুষ্টি লাভ হয়। তাই নিজের প্রবৃত্তি চাহিদার উপর তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়।

যে যুবক (সামথ্যবান হলে) কাবাগৃহের হজ পালন করে। যেহেতু সে আল্লাহকে ভালোবাসে, তাই তার গৃহকেও ভালোবাসে এবং তার করুণা ও ক্ষমার বিশেষ স্থানে উপস্থিত হয়ে ঐ স্থানে অন্যান্য আগত মুসলিমদের সহিত জামাআতে শরীক হওয়া পছন্দ করে।

যে যুবক আল্লাহ ও তার গ্রন্থ, রাসুল, মুসলিমদের নেতা এবং মুসলিম সর্বসাধারণের জন্য হিতাকাঙ্খী হয়। উদার ও উন্মুক্ত মনে প্রত্যেক মুসলিমের সাথে সুব্যবহার করে। যার মাঝে কোন প্রকারের প্রবঞ্চনা, ধোকাবাজি, লুকোচুরি, কুটিলতা ও কপটতা নেই। যে যুবক সজ্ঞানে ও সঠিক পদ্ধতি মতে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে। মহান আল্লাহ বলেন, “তুমি (মানুষকে) হিকমত (বিশেষ কৌশল, যুক্তি বা প্রজ্ঞা) এবং সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর এবং ওদের সাথে সদ্ভাবে তকালোচনা কর।” (কুঃ ১৬/১২৫) যে যুবক সৎকার্যের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে বাধা দান করে। যেহেতু সে জানে যে, এতে সমাজ ও উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ নিহিত আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যার অভ্যুত্থান হয়েছে। তোমরা সৎকার্যের আদেশ দান করবে এবং অসৎকার্য করতে নিষেধ করবে, আর আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে।” (কুঃ ৩১১০)

যে যুবক রসুলুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত পর্যায়ক্রম অনুযায়ী অসৎকর্ম দুরীকরণে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা রাখে। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজ হতে দেখে তার উচিত, তা নিজের হাত দ্বারা অপসারণ করা (শক্তি প্রয়োগ করে বাধা দান করা।) কিন্তু তাতে অক্ষম হলে জিহ্বা দ্বারা (নসীহত ও প্রতিবাদ করে তা বন্ধ করা), যদি তাতেও অক্ষম হয় তবে অন্তর দ্বারা (ঘৃণা করা)। আর এ হল দুর্বলতম ঈমানের পরিচায়ক।”

যে যুবক সদা সত্য বলে, সত্য স্বীকার ও গ্রহণ করে। যেহেতু সত্য সততার প্রতি এবং সততা বেহেস্তের প্রতি পথ প্রদর্শন করে। আর মানুষ সদা সত্য কথা বলতে থাকলে এবং সত্যবাদিতার চেষ্টা ও কামনা রাখলে আল্লাহর নিকট ‘সত্যবাদী’ বলে তার নাম লিখিত হয়ে থাকে।

যে যুবক মুসলিম জনসাধারণের জন্য সদা কল্যাণ কামনা ও পছন্দ করে, যেহেতু সে নবী এর এ কথায় বিশ্বাসী, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার (মুসলিম) ভায়ের জন্য তাই পছন্দ করেছে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।”

যে যুবক আল্লাহর দ্বীন, মুসলিম উম্মাহ ও স্বদেশের মঙ্গলবিষয়ক দায়িত্ব স্বীকার ও পালন করে। তাই সর্বদা সেই প্রচেষ্টা ও প্রয়াসে থাকে, যাতে দ্বীন, উম্মাহ ও দেশের কল্যাণ লাভ হয়। আর এই মহান প্রচেষ্টায় তার কোন অহমিকা থাকে না এবং নিজের স্বার্থ কায়েম করতে গিয়ে অপরের স্বার্থে আঘাত হানে না।

যে যুবক আল্লাহর জন্য, আল্লাহরই কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে, আল্লাহরই পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করে। ইখলাস ও চিত্তবিশুদ্ধতার সাথে সংগ্রামে তার উদ্দেশ্য, লোক-প্রদর্শন, ব্যক্তিগত অথবা স্বজনগত কোন স্বার্থলাভ, অথবা সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন থাকে না। আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করে, কোন প্রকার আত্মগর্ব প্রকাশ না করে, শক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভরসা ও নির্ভর না করে, দ্বীনের আওতাভুক্ত কোন কিছুতে অতিরঞ্জন অথবা অবহেলা না করে দ্বীন ও জাতির প্রয়োজন অনুপাতে জিহ্বা, কলম, হস্ত, জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে।

যে যুবক ধর্মভীর ও সদাচারী। যে চরিত্রে সভ্য, ধর্মে অটল, মনে উদার, ব্যবহারে বিনয়ী ও ভদ্র, আত্মমর্যাদায় সন্ত্রমশীল, হৃদয়ে সুন্দর, দ্বীনের দাওয়াতে সহিষ্ণ ও ধৈর্যশীল এবং জ্ঞানী ও দূরদর্শী, যে সুযোগের সদ্ব্যহার করে এবং জ্ঞান ও সংস্কারের উপর আবেগ ও উত্তেজনাকে প্রাধান্য দেয় না। যে যুবক মিতাচারী, সময় ও নিয়মানুবর্তী, কৌশল, হিকমত ও দুরদর্শীতার সাথে, নিপুণতা ও শৃঙ্খলতার সহিত প্রতি কাজ করে। তার জীবনের কোন অবকাশকে নিজের অথবা সমাজের কোন উপকার ব্যতীত বিনষ্ট করে না।

এই যুবক যেমন তার দ্বীন, চরিত্র ও ব্যবহারের সুরক্ষা করে তেমনি তার প্রতিকূল প্রত্যেক চিন্তা, মতবাদ, নাস্তিক্য, দুস্ক্রিয়া, পাপাচার, চরিত্রহীনতা ও দুব্যবহার থেকে সুদূরে থাকে।

সুতরাং এই শ্রেণীর যুবক দল উম্মতের গর্ব এবং তার দ্বীন, সমৃদ্ধ জীবন ও সৌভাগ্যের সংকেত। সেই যুবকদল; যাদের জন্য আল্লাহর নিকট আমরা আশা রাখি যে, তিনি তাদের

মাধ্যমে মুসলিমদের বিকৃত অবস্থার সংস্কার ও সংশোধন সাধন করবেন এবং সেই যুবকদলই ইহ-পরকালে বড় সৌভাগ্যবান হবে। দ্বিতীয় প্রকার যুবক, যে বিশ্বাসে ভ্রান্ত, চরিত্রে ভ্রষ্ট, আত্নগর্বী, নোংরামী ও অশ্লীলতায়। নিমজ্জিত। যে অপরের নিকট হতে সত্য গ্রহণ করে না এবং বাতিলকে বাতিল বলে স্বীকার ও তা পরিহার করে না। যে ব্যবহারে অহংকারী; যেন সে দুনিয়ার জন্য এবং দুনিয়াটা তারই জন্য সৃষ্টি হয়েছে।

যে যুবক স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত; যে ন্যায় ও সত্যের কাছে বিনয়ী নয়, অথচ অন্যায় ও বাতিলের একান্ত অনুগত।

যে যুবক আল্লাহর অধিকার এবং সৃষ্টির কত অধিকার বিনষ্ট করে, পরন্তু তার মনে কোন পরোয়া নেই। যেহেতু পরকাল ও হিসাবের প্রতি তার দৃঢ় অথবা মোটেই বিশ্বাস নেই।

যে যুবক সমাজে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী, বিবেক ও চিন্তায় ভারসাম্যহীন, চরিত্রে বিকারগ্রস্ত, ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণহারা, লাগামছাড়া।

যে যুবক নিজের অভিমত নিয়ে গর্বিত। যেন সত্য কেবল তারই রসনায় নিঃসৃত হয়। তাই সে যেন নিজের কাজে পদস্থলনমুক্ত এবং অন্য কেহ পদস্খলন ও ভ্রান্তিগ্রস্ত, যেহেতু তাদের রায় তার রায়ের পরিপন্থী।

যে যুবক ইসলামের সরল পথ থেকে বিচ্যুত, সামাজিক আচার অনুকরণ থেকে বৈমুখ এবং অধিকাংশে পাশ্চাত্য-সভ্যতায় প্রভাবিত। যার মন্দ কর্ম পরিশোভিত; যাকে সে উত্তম মনে করে থাকে। এমন যুবক স্বকর্মে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, যার পার্থিব জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা পণ্ড হয়, - যদিও সে মনে করে যে, সে সৎকর্ম করেছে।

এমন যুবক নিজের জন্য অশুভঙ্কর, সমাজের জন্য বালাই। যে সমাজকে অধঃপতনের অতল তলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। যার কারণে উম্মাহর মান মর্যাদা ও গৌরব উঠে যায়। এই শ্রেণীর তরুণ দল দুরারোগ্য সর্বনাশী মহামারীর জীবাণুর মত। অবশ্য আল্লাহ চাইলে কারো চিকিৎসা করেন এবং তিনি সর্ববস্তুর উপর সর্বশক্তিমান।

তৃতীয় প্রকার যুবক ও যে দুটানায় দোদুল্যমান, কর্মে যার দ্বৈধ থাকে। বিভিন্ন পথ ও মতের সম্মুখে সে হয়রান। যে যুবক সত্যের সন্ধান পায়, গ্রহণ করে সানিত হয় এবং আদর্শ সমাজে সে বসবাসও করে। কিন্তু অন্যদিকে তার জন্য মন্দের দুয়ার খোলা যায়, ফলে তার। আকীদাহ ও প্রতীতিতে সন্দেহ জন্মে, চরিত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি আসে, কর্মে নানান কলঙ্ক দৃষ্ট হয়। পুণ্যের মহফিলে যোগদান করলেও পাপের আখড়ায়ও তার আসন থাকে। ইসলামী সমাজে থেকে অনৈসলামী সমাজের অনুকরণ করে। বাতিলের প্রবাহমান স্রোতে কখনো গা ভাসিয়ে দেয়। তাই সে মানসিক দিক দিয়ে অস্থির থেকে ঐ স্রোতে ঘুরপাক খেতে থাকে। কখনো বা ঐ গতির সামনে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে হয়রান হয়ে ভাবতে থাকে; কি জানি এই নতুনত্বে ও আধুনিকতায় প্রকৃত সত্য নিহিত? নাকি সেই প্রাচীন মত ও পথে যার উপর বিগত সলফে সালেহীন ছিলেন এবং বর্তমানে আদর্শ সমাজ যার উপর প্রতিষ্ঠিত? যার ফলে সে সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন থাকে, কখনো বা এটাকে সমর্থন করে কখনো বা ওটাকে। এই শ্রেণীর যুবক দলের জীবন নেতিবাচক। এদের জন্য এমন এক শক্তিশালী আকর্ষক হেদায়াতের প্রয়োজন; যার দ্বারা তারা সত্যের আঙিনা ও কল্যাণের পথে আকৃষ্ট হয়ে ফিরে আসে এবং তা খুবই সহজ হয় তখনই, যখন আল্লাহ পাক তাদের জন্য কোন প্রজ্ঞাবান সৎ ও বিশুদ্ধ নিয়তে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী আলেমকে নির্বাচিত করে দেন।

এই শ্রেণীর যুবক তারাই অধিক হয়ে থাকে; যারা কিছু ইসলামী সভ্যতায় সভ্য হয়েছে, কিন্তু তার সাথে অন্যান্য পার্থিব ইলম (জেনেরাল এডুকেশনে)ও শিক্ষিত হয়েছে; যে ইলম ও শিক্ষা প্রকৃতই ইসলাম পরিপন্থী অথবা তাদের ধারণা মতে পরস্পর-বিরোধী। যার ফলে দুই সভ্যতার সামনে তারা হয়রান ও বিমুঢ় হয়ে পড়ে।

অবশ্য এই ধাঁধা, আকর্ষণ ও বিমূঢ়তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব; যদি তারা ইসলামী সভ্যতাকে জীবনাদর্শে মূলীভূত করে এবং মুখলেস ওলামাদের কাছে ঐ সভ্যতাকে তার আসল উৎস কুরআন ও হাদীস থেকে চয়ন করে। আর তা তাদের পক্ষে দুরূহ ও নয়। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ৬- ১৪ পৃঃ দ্রঃ)