মিশনারিগণ বলেন: যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন কাজেই তাঁর মর্যাদা বেশি।

প্রথমত: খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আপনি কি আপনার নবীর মু‘জিযা প্রমাণ করতে পারবেন? আমি আমার নবীর মু‘জিযা প্রমাণ করতে পারব। ঈসা মাসীহ শুধু তার যুগের নবী ছিলেন। এজন্য আল্লাহ তাঁকে ক্ষণস্থায়ী মু‘জিযা প্রদান করেন। তিনি মৃতকে জীবিত করেছিলেন এ কথা বিশ্বাস করা হয়, প্রমাণ করা যায় না। কোনো খৃস্টান মৃতকে জীবিত করে দেখাতে পারেন না। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সকল যুগের জন্য বিশ্বনবী; সেজন্য আল্লাহ তাকে অন্যান্য অগণিত মহান মু‘জিযার পাশাপাশি তাঁর শ্রে্ষ্ঠ মু‘জিযা দিয়েছেন কুরআন। সকল যুগেই কুরআনের মু‘জিযা প্রকাশিত। যে কোনো মুসলিমের জন্য তা প্রমাণ করা সম্ভব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বাদ দিলেও যে কোনো মুসলিম দু-তিন বৎসরে কুরআন মুখস্থ করে এর অলৌকিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন; কিন্তু কোনো খৃস্টান কি ২০ বা ২০০ বছরে ইঞ্জিল শরীফ মুখস্থ করতে[1] বা কুরআনের মত একটি গ্রন্থ লিখে দিতে পারবেন?

দ্বিতীয়ত, মৃতকে জীবিত করা যদি মর্যাদার মাপকাঠি হয় তাহলে খৃস্টানদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, যিহিষ্কেল নবী ঈসা মাসীহের চেয়ে হাজারগুণ বেশি মর্যাদাবান। কারণ, ইঞ্জিলের উল্টোপাল্টা বর্ণনা সত্য ধরলে যীশু মাত্র তিনজন মৃতকে জীবিত করেন। অথচ যিহিষ্কেল ভাববাদী হাজার হাজার মৃত মানুষকে জীবিত করেন (যিহিষ্কেল ৩৭/১-১৪)। এছাড়া এলিয় নবী (Elijah) একটি মৃত শিশুকে পুনর্জীবিত করেন (১ রাজাবলির ১৭/১৭-২৪)। ইলীশায় (Elisha) নবী একজন মৃত বালককে পুনর্জীবিত করেন (২ রাজাবলির ৪/৮-৩৭)। তাহলে খৃস্টান প্রচারকদের স্বীকার করতে হবে যে, এলিয় এবং ইলীশায় নবীর মর্যাদা ইবরাহীম, মূসা, দায়ূদ ও যীশুর ১২ শিষ্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

তৃতীয়ত: বস্তুত, নবীগণ দুচারজন মৃতকে জীবিত করতে আসেন না। তাঁরা আসেন মৃত হৃদয়কে ঈমান দ্বারা জীবিত করতে। বাইবেলের ভাষ্যানুসারে যীশু ২/৩ জন মৃতকে জীবিত করলেও তিনি মানুষদেরকে ঈমানদার বানাতে পারেন নি। খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, যীশুর বারো জন প্রেরিত শিষ্যের মর্যাদা মোশি ও অন্য সকল ইস্রায়েলীয় নবী-রাসূলের চেয়ে বেশি। যীশু তাদেরকে নুবুওয়াত প্রদান করেন, মৃতকে জীবিত করা সহ সকল অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন এবং তারা পাক রূহ বা পবিত্র আত্মায় পরিপূর্ণ হন। ইঞ্জিলের বর্ণনানুসারে এ মহান নবীগণকেও ঈসা মাসীহ ঈমান শিক্ষা দিতে পারেন নি। তাঁদের ঈমানের হাল-হাকীকত দেখুন!

(ক) পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগের রাতে যীশু অত্যন্ত ভীত, দুঃখার্ত ও ব্যাকুল ছিলেন। তিনি শিষ্যদেরকে বলেন: আমার প্রাণ মারাত্মক (মরণ পর্যন্ত) দুঃখার্ত, তোমরা এখানে থাক এবং আমার সাথে জেগে থাক। পরে তিনি কিঞ্চিত অগ্রসর হয়ে উবুড় হয়ে (সাজদা করে) প্রার্থনা করেন (সালাত আদায় করেন)। পরে তিনি শিষ্যদের নিকটে এসে দেখেন যে, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তিনি পিতরকে বললেন, এ কি? এক ঘণ্টাও কি আমার সঙ্গে জেগে থাকতে তোমাদের শক্তি হল না? জেগে থাক ও প্রার্থনা কর। এরপর তিনি দ্বিতীয় বার গিয়ে আবার প্রার্থনা করলেন। পরে তিনি আবার এসে দেখেন যে, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। (মথি ২৬/৩৬-৪৬)।

ঈমানের কোনো নমুনা কি এখানে দেখা যায়? পৃথিবীর সাধারণ পাপী মানুষদের দিকে তাকান। যদি তাদের কোনো নেতা বা কোনো আপনজন অত্যন্ত দুঃখার্ত ও অস্থির থাকেন, অথবা অসুস্থ থাকেন তবে তারা সে রাতে ঘুমাতে পারেন না। জগতের সবচেয়ে পাপী মানুষটিও এরূপ অবস্থায় ঘুমাতে পারবেন না।

(খ) এরপর যখন ইয়াহূদীরা যীশুকে গ্রেফতার করল তখন এ মহা-মর্যাদাবান শিষ্যগণ যীশুকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছিলেন (মথি ২৬/৫৬)।

(গ) ১২ শিষ্যের একজন ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা (Judas Iscar'i-ot)। পাকরূহে পরিপূর্ণ (মথি ১০/১-৮) এ শিষ্যের বিষয়ে যোহন উল্লেখ করেছেন যে, তিনি চোর ছিলেন (যোহন ১২/৪-৬)। সর্বোপরি তিনি ৩০ টাকার বিনিময়ে যীশুকে হত্যার জন্য ইয়াহূদীদের হাতে তুলে দেন। (মথি ২৬ ও ২৭ অধ্যায়)

(ঘ) দ্বিতীয় শিষ্য পিতর। ঈসায়ীগণের বিশ্বাস অনুসারে তিনিই ছিলেন যীশুর স্থলাভিষিক্ত ও প্রেরিতগণের প্রধান। অন্য শিষ্যদের মতই তিনি যীশুকে দুঃখার্ত ও ব্যাকুল দেখেও শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং তাঁকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যান। তবে অন্যদের চেয়েও অতিরিক্ত একটি কর্ম করে তিনি অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করেন। যখন উপস্থিত জনতার কেউ কেউ পিতরকে চিনতে পেরে বলে যে, এ ব্যক্তি গ্রেফতারকৃত যীশুর সাথীদের একজন, তখন তিনি যীশুকে গালি দিয়ে বারংবার শপথ করে বলতে থাকেন যে, তিনি যীশুকে চিনেনই না! (মথি ২৬/৬৯-৭৫; মার্ক ১৪/৬৬-৭২; লূক ২২/৫৫-৬২; যোহন ১৮/১৬-১৮ ও ২৫-২৭)।

ইঞ্জিলের বর্ণনায় এ হলো যীশুর ঈমান শেখানোর অবস্থা। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের লক্ষাধিক বর্বর মৃত হৃদয়ের মানুষের মৃত হৃদয়কে জীবিত করে অনন্ত জীবন দান করেন, যারা সাধারণ একজন মানুষের জীবন রক্ষার জন্যও নিজেদের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

চতুর্থত: অলৌকিক কার্যে মর্যাদা বৃদ্ধি হয় না। ইঞ্জিলে বলা হয়েছে যে, ভণ্ডগণ ও দাজ্জালও এভাবে মহা-অলৌকিক কাজ করবে (মথি ২৪/২৪, ২ থিষলনীকীয় ২/৯)। নবীগণের প্রকৃত মর্যাদা মানব সমাজকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করায়। বাইবেলের যীশু এ বিষয়ে কিছুই করেন নি। তিনি মানুষদেরকে হেদায়াত করতে পারেন নি। সমাজ থেকে জুলুম, নিপীড়ন, অনাচার বা দুর্নীতি উঠাতে পারেন নি। নতুন কোনো বিশ্বাস বা নৈতিকতার প্রসার তিনি করতে পারেন নি।

খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে তিনি শুধু এসেছেন, ক্রুশে জীবন দিয়ে মানুষদের পাপক্ষয় করে চলে গিয়েছেন। উপরন্তু মানুষদের জাহান্নামী করার ব্যবস্থা করেছেন। কারণ, খৃস্টানদের দাবি অনুযায়ী, মানুষকে জান্নাতী হতে হলে তাঁর ঈশ্বরত্বে, প্রায়শ্চিত্বে ও পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু সবগুলি বিষয়ই তিনি গোপন করে গিয়েছেন। তার ঈশ্বরত্বের কথা স্পষ্ট করে বলেন নি। প্রকাশ্যে মু‘জিযা না দেখিয়ে গোপন করেছেন। অন্তত কবর থেকে বেরোনোর পরে যেরুজালেমে একটু দেখা দিলে সকলেই বিশ্বাস করে জান্নাতী হতে পারত। শতমুখে প্রচারিত হলে বিশ্বের সকল মানুষ বিশ্বাস করত। তিনি তাও করেন নি। গোপনেই চলে গেছেন। আমরা দেখেছি যে, এজন্যই খৃস্টানগণ আজ পর্যন্ত তাদের ‘ঈমান’ কী তা ঠিক করতে পারেন নি। ফলে একে অপরকে জাহান্নামী বলেছেন ও কোটি কোটি খৃস্টান মারামারি করে মরেছেন।পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার ক্রান্তিলগ্নে এসেছেন, নতুন বিশ্বাস ও নৈতিকতায় মানব জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন, সমাজ থেকে জুলুম, দুর্নীতি, মাদকতা, অনাচার ও অবিচার উৎখাত করেছেন এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রদান করেছেন।

>
[1] মুখস্থ করা তো দূরে থাক, সেটার মূল কপিই তো প্রমাণ করতে পারবে না। [সম্পাদক]