সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা এ শির্কী বিশ্বাস প্রমাণের জন্য জালিয়াতি ও অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। আমরা দেখেছি, কিভাবে তাঁরা বান্দার স্থানে পুত্র লিখে, কিছু কথা মুছে এবং কিছু কথা যোগ করে ত্রিত্ব ও যীশুর ঈশ্বরত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

আমরা জেনেছি যে, ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলিও’ পলীয় ধর্মের প্রাধান্য লাভের পর তাঁর অনুসারীদের দ্বারা গ্রীক ভাষায় সংকলিত ‘বেনামী’ ইঞ্জিল। এরপরও এ সকল ইঞ্জিলের মধ্যে ঈসা মাসীহের আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর বান্দা হওয়ার পক্ষে, ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সমতুল্য না হওয়ার পক্ষে অগণিত প্রমাণ বিদ্যমান। উপরে আমরা সামান্য কিছু উল্লেখ করলাম। এর বিপরীতে প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলি’-র মধ্যে যীশুর ঈশ্বরত্বের পক্ষে তাঁর একটিও সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তবে চতুর্থ ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান তাঁর কিছু কথাকে ত্রিত্ববাদীরা তার ঈশ্বরত্বের প্রতি ‘ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

প্রথমত: মহান আল্লাহ সকল মানুষের প্রেমময় স্রষ্টা। দুনিয়ায় যে যেমনই হোক না কেন সকলেই যেন সহজে মুক্তির পথ বুঝতে ও মানতে পারে এজন্য তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। যে বিশ্বাসের উপর মানুষের মুক্তি নির্ভর করে সে বিশ্বাস যদি ধর্ম প্রচারক বুদ্ধিমান-নির্বোধ প্রত্যেক মানুষের সহজে বুঝার মত সহজবোধ্য ও দ্ব্যর্থহীনভাবে না বলেন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি ভণ্ড প্রচারক। তিনি মানুষকে সত্যের সন্ধান দেন নি; বরং সত্যকে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য করেছেন। ঈমান ও নাজাতের বিষয় ছাড়া অন্যান্য উপদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কোনো নবী-রাসূল অলঙ্কার-এর আশ্রয় নিতে পারেন; কিন্তু মুক্তির দিশাকে তিনি অস্পষ্ট করতে পারেন না।

দ্বিতীয়ত: কোনো মহাপুরুষের কোনো কথা যদি তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীত হয় তাহলে তা জাল বলে গণ্য হবে অথবা তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ মানুষের মুক্তির যে মূলমন্ত্র বারংবার উল্লেখ করেছেন, তা হলো ‘আল্লাহর প্রকৃত ও ব্যাখ্যাবিহীন একত্বে বিশ্বাস করা’। কিতাবুল মোকাদ্দসেও তাই বলা হয়েছে। কাজেই এ কথার উল্টা কোনো কথা যদি পাওয়া যায় তবে তাকে এ সুস্পষ্ট মূলনীতির ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করতে হবে।

তৃতীয়ত: চতুর্থ ইঞ্জিল বা যোহনের ইঞ্জিলের বিষয়ে আমরা দেখেছি যে, গ্রন্থটি মূলতই জাল। এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে খৃস্টান পণ্ডিতদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। তবে তারা সকলেই একমত যে, এ গ্রন্থটি আলঙ্কারিক গ্রীকভাষায় লেখা এবং এতে ব্যাপকভাবে রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এগুলির ব্যাখ্যা অন্য তিন ইঞ্জিলের সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে করতে হবে।

চতুর্থত: সবচেয়ে বড় কথা, পলীয় খৃস্টানগণ যীশুর যে বক্তব্যগুলি তাঁর ‘ঈশ্বরত্বের ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন, ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর অন্যান্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, সেগুলো অন্য বিষয়ের ইঙ্গিত। ত্রিত্ববাদীদের প্রমাণগুলি দেখুন:

(১) “তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা অধঃস্থানের, আমি ঊর্ধ্বস্থানের; তোমরা এ জগতের, আমি এ জগতের নহি।” (যোহন ৮/২৩)। পলীয়গণ প্রচার করেন যে, এখানে যীশু তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রতি “ইঙ্গিত” করেছেন। অথচ যীশু ঠিক একই কথা শিষ্যদেরকেও বলেছেন: “তোমরা যদি জগতের হইতে, তবে জগৎ আপনার নিজস্ব বলিয়া ভালোবাসিত; কিন্তু তোমরা ত জগতের নহ..” (যোহন ১৫/১৯)। “আমি তাহাদিগকে তোমার বাক্য দিয়াছি; আর জগৎ তাহাদিগকে দ্বেষ করিয়াছে, কারণ তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই। ... তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই।” (যোহন ১৭/১৪-১৬)

প্রথম বক্তব্য যদি যীশুর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হয় তবে পরের দুটি বক্তব্য প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর দুই বা তিনজন নন; বরং অন্তত ১৪/১৫ জন!

(২) যীশু বলেন: “আমি ও পিতা, আমরা এক (I and my Father are one)।” (যোহন ১০/৩০)। খৃস্টানগণ দাবি করেন, এ কথাটি তাঁর ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করে। অথচ যীশু ঠিক একই কথা বলেছেন শিষ্যদের বিষয়ে। তিনি বলেন: “যেন তাহারা সকলে এক হয়; পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে এক থাকে (That they all may be one; as thou, Father, art in me, and I in thee, that they also may be one in us)... আর তুমি আমাকে যে মহিমা দিয়াছ, তাহা আমি তাহাদিগকে দিয়াছি; যেন তাহারা এক হয়, যেমন আমরা এক (that they may be one, even as we are one); আমি তাহাদের মধ্যে ও তুমি আমাতে, যেন তাহারা একের মধ্যে পরিপূর্ণতা লাভ করে (যেন তাহারা সিদ্ধ হইয়া এক হয়) (I in them, and thou in me, that they may be made perfect in one)।” (যোহন: ১৭/২১-২৩)

তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, যীশুকে যে ঈশ্বরত্ব প্রদান করেছিলেন পিতা ঈশ্বর সে ঈশ্বরত্ব তিনি শিষ্যদেরকে প্রদান করলেন এবং পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর ও শিষ্য ঈশ্বরগণ সকলে মিলে ১৫ ঈশ্বর!

(৩) যীশু বলেন: “যে আমাকে দেখিয়াছে, সে পিতাকে দেখিয়াছে; তুমি কেমন করিয়া বলিতেছ, পিতাকে আমাদের দেখাউন? ... আমি পিতাতে আছি এবং পিতা আমাতে আছেন আমি তোমাদিগকে যে সকল কথা বলি, তাহা আপনা হইতে বলি না; কিন্তু পিতা আমাতে থাকিয়া আপনার কার্য সকল সাধন করেন।”(যোহন ১৪/৯-১০)। পলীয় খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, এটি তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ; কারণ তিনি বলেছেন যে, তাঁকে দেখলেই পিতাকে দেখা হয় এবং পিতা তার মধ্যে রয়েছেন। মজা হলো, তিনি শিষ্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন: “সেই দিন তোমরা জানিবে যে, আমি আমার পিতাতে আছি, ও তোমরা আমাতে আছ, এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি।” (যোহন ১৪/২০)। আরো বলেন: “পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে থাকে (that they also may be one in us)।” (যোহন ১৭/২১)

তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, শিষ্যগণও ঈশ্বর ছিলেন? উপরন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলে বলা হয়েছে, সকলের মধ্যেই ঈশ্বর বসত করেন (১-করিন্থীয় ৬/১৯-২০; ২-করিন্থীয় ৬/১৬; ইফিষীয় ৪/৬)। তাহলে কি সকলেই ঈশ্বর?

বাইবেলে মানুষদেরকে god বলা হয়েছে। যাত্রাপুস্তক ৭/১: “সদাপ্রভু মোশিকে কহিলেন, দেখ, আমি ফরৌনের (ফেরাউনের) কাছে তোমাকে একজন আল্লাহ করিয়া (I have made thee a god to Pharaoh: বাংলায় “ঈশ্বর স্বরূপ”, “আল্লাহর মত”) নিযুক্ত করিলাম; আর তোমার ভ্রাতা হারোণ (হারুন) তোমার ভাববাদী (নবী) হইবে”। (গীতসংহিতা/যাবূর ৮২/৬: (I have said, Ye are gods; and all of you are children of the Most High): আমি বলেছিলাম: তোমরা আল্লাহ, তোমরা সবাই আল্লাহ তা‘আলার সন্তান” (কিতাবুল মোকাদ্দসে: তোমরা যেন আল্লাহ’: ‘যেন’ শব্দটি সংযোজিত) । শুধু আল্লাহর পুত্র নয়, মূসা (আঃ) এবং সকল মানুষই আল্লাহ! এগুলি কি আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে? না কিতাবুল মোকাদ্দসের অন্যান্য বক্তব্যের আলোকে বুঝতে হবে?

ঈসা মাসীহের উপরের কথাও তাঁর ও নবীগণের সুস্পষ্ট কথার আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। কিতাবুল মোকাদ্দস বারংবার বলেছে যে, ঈশ্বরকে দেখা যায় না; যা দেখা যায় তা ঈশ্বর নয়; তিনি কারো মধ্যে থাকেন না; তিনি কারো মত নয়; তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। কাজেই উপরের কথাগুলি এ মূলনীতির আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। বস্তুত, কারো মধ্যে আল্লাহর অবস্থান, কারো সাথে আল্লাহর এক হওয়া, কাউকে দেখলে আল্লাহকে দেখা ইত্যাদির অর্থ তার সাথে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা, প্রেম, তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যে আল্লহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা ইত্যাদি।

মজার বিষয় হলো ত্রিত্ববাদী পলীয় খৃস্টানগণও এগুলি বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করেন না। তারা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে পিতা ঈশ্বর ও পুত্র ঈশ্বর এক বা যীশুর দেহ দেখলে প্রকৃতই পিতা ঈশ্বরকে দেখা হয়। বরং তারা বিশ্বাস করেন পিতা পুত্র নন এবং পুত্রও পিতা নন; তারা উভয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন ব্যক্তি। এরপরও তাঁরা এ সকল কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন।