সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজিব - ১

প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন, আমাদের উপর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে আমাদের জন্য মনোনীত করেছেন। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তার সেই বান্দা ও রাসূলের উপর যাকে প্রেরণ করা হয়েছে তাঁর রবের আনুগত্যের দিকে আহ্বানকারী এবং বাড়াবাড়ি, বিদ‘আত ও পাপ থেকে সতর্ককারী হিসেবে। আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার পরিজন, সকল সাথীবর্গ এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পথের অনুসারী ও তাঁর সুন্নাতের অনুসারীদের উপর রহমত বর্ষণ করুন।

অতঃপর,

সাপ্তাহিক উর্দু পত্রিকা (ইদারাত) এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ দেখতে পেলাম যা ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি শিল্প এলাকা কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু ছিল: ‘‘সৌদী আরব ও এর আকীদা আঁকড়ে ধরা এবং বিদ‘আত প্রতিরোধের সংগ্রাম করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন’’। সালাফী আকীদার উপর এ অপবাদ দেওয়া দ্বারা লেখকের উদ্দেশ্য হলো আহলে সুন্নাতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা এবং বিদ‘আত ও কুসংস্কারের উপর উৎসাহ দেওয়া ।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি একটি খারাপ উদ্দেশ্য এবং ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ, যার উদ্দেশ্য হলো দ্বীন ইসলামের ক্ষতি করা এবং বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতা প্রচার করা। তারপর এ প্রবন্ধটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের জন্ম দিবস পালনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এবং একে কেন্দ্র করেই সৌদী আরবের আকীদা বাস্তবায়ন সম্পর্কে কথা বলেছে। কাজেই এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়াটাই ভালো মনে করছি। সুতরাং আমি বলব:

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অন্য যে কারো জন্ম দিবস পালন করা জায়েয নেই বরং তা নিষেধ করা ওয়াজিব, কারণ তা দ্বীনের মধ্যে একটি নব আবিষ্কৃত বিদ‘আত যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো করেননি, তিনি তাঁর নিজের জন্য বা তাঁর পূর্বে মৃত্যুবরণকারী কোনো নবী, তাঁর মেয়েগণ বা স্ত্রীগণ বা তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন অথবা কোনো সাহাবীর জন্ম দিবস পালন করার নির্দেশ দেননি। এমনকি তাঁর কোনো খালীফায়ে রাশেদ বা সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম অথবা কোনো তাবে‘ঈ এবং স্বর্ণযুগে সুন্নাতে মুহাম্মাদিয়ার কোনো আলেম তা করেননি। অথচ তারাই সুন্নাত সম্পর্কে সকলের চেয়ে বেশী অবগত এবং রাসূলের মহব্বতের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে এবং তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে তাঁর বেশী অনুসরণকারী। যদি তা পালন করা ভালো হতো, তাহলে অবশ্যই তারা আমাদের চেয়ে আগে পালন করতেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিদ‘আত সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করেছেন। কারণ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন, আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রাসূল যা শরীয়ত হিসাবে দিয়েছেন এবং যা আহলে সুন্নাত ও জামা‘আত তথা সাহাবা ও তাবে‘ঈগণ গ্রহণ করেছেন তা-ই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি বলেছেন,

«من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد» متفق على صحته

“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো জিনিস আবিষ্কার করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”[1]

অন্য বর্ণনায় এসেছে:

«من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد»

“যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে যা আমার শরীয়ত সমর্থিত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”

তিনি অন্য হাদীসে আরও বলেন:

«عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ وإياكم ومحدثات الأمور فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة»

“তোমাদের উপর ওয়াজিব হলো: তোমরা আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং আমার পর সুপথ প্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং তা দন্ত দ্বারা দৃঢ়তার সাথে ধারণ কর আর (দ্বীনে) নব রচিত কর্মসমূহ হতে সাবধান থাক! কেননা প্রতিটি নব রচিত কর্ম হচ্ছে বিদ‘আত এবং সকল বিদ‘আত হচ্ছে ভ্রষ্টতা।”[2]

এবং তিনি জুম‘আর দিন তাঁর খুৎবায় বলেন:

«أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة»

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো দ্বীনে নব আবিষ্কৃত কাজ এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”[3]

উপরোল্লেখিত হাদীসগুলোতে বিদ‘আত সৃষ্টি করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তা একটি ভ্রষ্টতা, এবং এর ভয়াবহতা থেকে সকল উম্মতকে সতর্ক করা হয়েছে এবং এর নিকটবর্তী হওয়া ও এর উপর আমল করা থেকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ অর্থে আরো বহু হাদীস রয়েছে ।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]

“আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বারণ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।” [সূরা হাশর, ৭]

তিনি আরও বলেন:

﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور: ٦٣]

“অতএব, যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, তাদেরকে বিপর্যয় স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” [সূরা নূর, ৬৩]

তিনি আরও বলেন:

﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب: ٢١]

“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আহযাব/২১]

তিনি আরও বলেন:

﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠ ﴾ [التوبة: ١٠٠]

“আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী, আনসার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সকল লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন সেই জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীসমূহ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হলো মহা কৃতকার্যতা।” [সূরা তাওবা/১০০]

তিনি আরও বলেন:

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣]

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম। [সূরা মায়েদা/৩]

এ সকল আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং তার নেয়ামতকে তাদের উপর সম্পন্ন করেছেন। তিনি তার নবীকে মৃত্যুদান করেননি যতক্ষণ না তিনি স্পষ্টভাবে উম্মতের নিকট তা পৌঁছিয়েছেন এবং আল্লাহ যা শরীয়ত করেছেন তা তাদের জন্য বর্ণনা করেছেন, চাই তা কথা হোক বা কাজ হোক এবং এও স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে যারা নতুন কিছু আবিষ্কার করে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করবে তা কথা হোক বা কাজ হোক এ সবই বিদ‘আত বলে গণ্য হবে এবং তা এর আবিষ্কারকের উপর ফিরিয়ে দেওয়া হবে যদিও তার উদ্দেশ্য ভালো থাকে।

তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সকল সাহাবী এবং তাদের পরবর্তী সালাফদের নিকট থেকে বিদ‘আত থেকে সতর্কতা এবং ভীতি প্রদর্শন সাব্যস্ত রয়েছে। তা কেবল দ্বীনের মধ্যে অতিরিক্ত হওয়ার কারণেই হয়েছে এবং সে শরিয়ত প্রবর্তনের কারণে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি এবং আল্লাহদ্রোহী ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের সামঞ্জস্য বিধানের কারণে; কারণ তারা তাদের দ্বীনের মধ্যে অতিরিক্ত করেছে এবং যা আল্লাহ বলেননি তা দ্বীনের মধ্যে আবিষ্কার করেছে। আর এতে (এভাবে বিদ‘আত চালু করলে) দ্বীনের সংকীর্ণতা এবং অপরিপূর্ণতার অপবাদ আসে অথচ সকলেরই জানা যে, এটি করা হলে মহা ফেৎনার সৃষ্টি করবে এবং অত্যন্ত খারাপ কাজ বলে বিবেচিত হবে, সাথে সাথে তা আল্লাহর সে বাণীর বিরোধী হবে যেখানে তিনি বলেছেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ “আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” অনুরূপভাবে রাসূলের সেই হাদীসগুলোরও বিরোধী হবে যাতে তিনি বিদ‘আত থেকে তিনি সতর্ক করেছেন ও বিরত থাকতে বলেছেন।

তদ্রূপ, এ সকল জন্মোৎসব ও অন্যান্য উৎসবের আবিষ্কার করায় প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেননি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমল করার মত রিসালত তার জাতির জন্য যথাযথভাবে পৌঁছাননি, পরবর্তীতে এ বিদ‘আতরে প্রর্বতক লোকগুলো এসে আল্লাহর শরিয়তে এমন কিছু বিধান আবিষ্কার করল যার অনুমতি আল্লাহ দেননি, তারা মনে করেছে তা হয়তো তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এতে মহাবিপদ রয়েছে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তার বান্দার জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং তার নেয়ামতকে সম্পন্ন করেছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। এমন কোনো পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে তিনি তা উম্মাতের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পিছপা হন নি। যেমন সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّهُ لَمْ يَكُنْ نَبِيٌّ قَبْلِي إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ يَدُلَّ أُمَّتَهُ عَلَى خَيْرِ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ، وَيُنْذِرَهُمْ شَرَّ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ»

“আল্লাহ ইতোপূর্বে যে কোনো নবীই প্রেরণ করেছেন তার দায়িত্ব ছিল, তিনি তার উম্মতের জন্য যা ভালো মনে করেন তার দিক নির্দেশনা দেওয়া এবং তাদের জন্য যা ক্ষতি মনে করেন তা থেকে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা।”[4]

>
[1] বুখারী হাদীস নং ২৬৯৭ ও মুসলিম হাদীস নং ১৭১৮।

[2] আহমাদ ১৬৬৯৫, আবু দাউদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৬৭৬ এবং ইবনে মাজাহ ৪২

[3] মুসলিম শরীফ, জুময়া অধ্যায়: খুৎবা ও নামায হালকাকরণ অনুচ্ছেদ, হাদীস নং ৮৬৭।

[4] মুসলিম, হাদীস নং ১৮৪৪।