স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো পর্দা নেই উভয়েই এক অপরের পোশাক।

উভয়েই উভয়ের সর্বাঙ্গ দেখতে পারে। তবে সর্বদা নগ্ন পোশাকে থাকা উচিত নয়।

মা-বেটার মাঝে পর্দা ও গোপনীয় কেবল নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত। অন্যান্য নিকটাত্মীয়; যাদের সাথে চিরকালের জন্য বিবাহ হারাম তাদের সামনে পর্দা ও গোপনীয় অঙ্গ হল গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত।

অবশ্য কোনো চরিত্রহীন এগানা পুরুষের কথায় বা ভাবভঙ্গিতে অশ্লীলতা ও কামভাব বুঝলে, মহিলা তার নিকটেও যথা সম্ভব অন্যান্য অঙ্গও পর্দা করবে।

মহিলার সামনে মহিলার পর্দা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। মহিলা কাফের হলে তার সামনে হাত ও চেহারা ছাড়া অন্যান্য অঙ্গ খোলা বৈধ নয়। যেমন, কোনো নোংরা ব্যভিচারিণী মেয়ের সামনেও নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করা উচিত নয়। অনুরূপ এমন কোনো মহিলার সামনেও দেহসৌষ্ঠব খোলা নিষিদ্ধ; যে তার কোনো বন্ধু বা স্বামীর নিকট অন্য মহিলার রূপচর্চা করে বলে জানা যায় বা আশঙ্কা হয়। এমন মহিলার সাথে মুসলিম মহিলার সখীত্ব বা বন্ধুত্বও বৈধ নয়।

মা-বাপের চাচা ও মামা, মেয়ের চাচা ও মামা মাহরাম। সুতরাং চাচাতো দাদো বা নানার সামনে পর্দা গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত।

তালাকের পর ইদ্দত পার হয়ে গেলে ঐ স্বামী এই স্ত্রীর জন্য বেগানা হয়ে যায়। সুতরাং তার নিকটে পর্দা ওয়াজেব।

পালিত পুত্র থেকে পালয়িত্রী মায়ের এবং পালয়িতা বাপ থেকে পালিতা কন্যার পর্দা ওয়াজেব। প্রকাশ যে, ইসলামে এ ধরনের প্রথার কোনো অনুমতি নেই।

অনুরূপ পাতানো ভাই বোন, মা-বেটা, বাপ-বেটির মাঝে, পীর ভাই-বোন (?)[1] বিয়াই-বিয়ান ও বন্ধুর স্বামী বা স্ত্রীর মাঝে পর্দা ওয়াজেব। যদিও তাদের চরিত্র ফিরিশতার মত হয় তবুও দেখা দেওয়া হারাম। পর্দা হবে আল্লাহর ভয়ে তাঁর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে। মানুষের ভয়ে বা লোক প্রদর্শনের জন্য নয়। এতে মানুষের চরিত্র ও সম্মান বিচার্য নয়। সুতরাং লম্পট, নারীবাজ, পরহেজগার, মৌলবি সাহেব প্রভৃতি পর্দায় সকলেই সমান। আল্লাহর ফরয মানতে কোনো প্রকারের লৌকিকতা ও সামাজিকতার খেয়াল অথবা কারো মনোরঞ্জনের খেয়াল নিশ্চয় বৈধ নয়।

দৃষ্টিহীন অন্ধ পুরুষের সামনে পর্দা নেই। অবশ্য মহিলাকে ঐ পুরুষ থেকে দৃষ্টি সংযত করতে হবে।

পৃথক মহিলা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান না থাকলে বেপর্দায় ছেলেদের সাথে একই সাথে পাশাপাশি বসে শিক্ষা গ্রহণ বৈধ নয়। স্বামী-সংসার উদ্দেশ্য হলে বাড়িতে বসে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বই-পুস্তক পড়া এবং দ্বীন-সংসার শিখার শিক্ষাই যথেষ্ট। অন্যান্য শিক্ষার প্রয়োজনে যথাসম্ভব পর্দার সাথে শিখতে হবে। পর্দার চেষ্টা না করে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে অবশ্যই মেয়ে-অভিভাবক সকলেই পাপী হবে।

চিকিৎসার প্রয়োজনে মহিলার জন্য ডাক্তার খোঁজা ওয়াজেব। লেডী ডাক্তার না পেলে অথবা যথাবিহিত চিকিৎসা তার নিকট না হলে বাধ্য হয়ে পুরুষ ডাক্তারের নিকট যেতে পারে। তবে শর্ত হল মহিলার সাথে তার স্বামী অথবা কোনো মাহরাম থাকবে। একাকিনী ডাক্তার-রুমে যাবে না। পরন্তু ডাক্তারকে কেবল সেই অঙ্গ দেখাবে, যে অঙ্গ দেখানো প্রয়োজন। লজ্জা স্থান দেখলেও অন্যান্য অঙ্গ দেখানো অপ্রয়োজনে বৈধ হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ ١٦ ﴾ [التغابن : ١٦]

“তোমরা আল্লাহকে যথাসম্ভব ভয় কর”।[2] (সাধ্যমত ভয় করার চেষ্টা কর।)

একাকিনী হলেও নামাযে আদবের লেবাস জরুরী। এই সময় কেবল চেহারা ও হাত খুলে রাখা যাবে। শাড়ি পরে বাহু-পেট-পিঠ-চুল বের হয়ে গেলে নামায হয় না। যেমন, সম্মখে বেগানা পুরুষ থাকলে চেহারাও ঢাকতে হবে।

সেলোয়ার-কামিস বা ম্যাক্সিতে নামায পড়লে চাদর জরুরী। কুরআন শরীফ পড়তে গিয়ে মাথা খুলে গেলে ক্ষতি নেই। এতে ওযুও নষ্ট হয় না। আল্লাহ বলেন,

﴿وَٱلۡقَوَٰعِدُ مِنَ ٱلنِّسَآءِ ٱلَّٰتِي لَا يَرۡجُونَ نِكَاحٗا فَلَيۡسَ عَلَيۡهِنَّ جُنَاحٌ أَن يَضَعۡنَ ثِيَابَهُنَّ غَيۡرَ مُتَبَرِّجَٰتِۢ بِزِينَةٖۖ وَأَن يَسۡتَعۡفِفۡنَ خَيۡرٞ لَّهُنَّۗ ٦٠ ﴾ [النور : ٦٠]

“বৃদ্ধা নারী; যারা বিবাহের আশা রাখে না, তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে যদি বহির্বাস খুলে রাখে তাহলে তা দোষের নয়। তবে পর্দায় থাকাটাই তাদের জন্য উত্তম”।[3]

যেহেতু কানা বেগুনের ডগলা খদ্দেরও বর্তমান। পর্দায় থাকলে বাড়ির লোক ঠাট্টা করলে এবং কোনো প্রকার অথবা সর্বপ্রকার সহায়তা না করলে মহিলার উচিত যথাসম্ভব নিজে নিজে পর্দা করা। এ ক্ষেত্রে হাল ছেড়ে বসা বৈধ নয়। কল-পায়খানা নেই বলে ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। স্বামী পর্দায় থাকতে না দিলে চেষ্টার পরও যদি একান্ত নিরুপায় হয়ে বেপর্দা হতে হয় তবুও যথাসাধ্য নিজেকে সংযত ও আবৃত করবে। আল্লাহ এ চেষ্টার অন্তর দেখবেন। যারা সহায়তা করে না বা বাধা দেয় তাদের পাপ তাদের উপর।

পক্ষান্তরে বেগানা পুরুষ দেখে ঘর ঢুকলে বা মুখ ঢাকলে যারা হাসাহাসি করে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, কটাক্ষ হানে অথবা অসমীচীন মন্তব্য করে বা টিস্ মারে, শরয়ী পর্দা নিয়ে যারা উপহাস করে তারা কাফের। এই পর্দানশীন মহিলারা কাল কিয়ামতে ঐ উপহাসকারীদেরকে দেখে হাসবে।

সুতরাং মুমিন নারীর দুঃখ করা উচিত নয়, একাকিনী হলেও মন ছোট করা সমীচীন নয়। সত্যের জয় অবধারিত, আজ অথবা কাল। মরতে সকলকেই হবে, প্রতিফল সকলেই পাবে।

‘মরে না মরে না কভু সত্য যাহা, শত শতাব্দীর বিস্মৃতির তলে

নাহি মরে উপেক্ষায়, অপমানে হয় না চঞ্চল, আঘাতে না টলে।’

পর্দায় থাকার জন্য দেওর-ভরা সংসার থেকে পৃথক হয়ে আলাদা ঘর বাড়ি করার জন্য স্ত্রী যদি তার স্বামীকে তাকীদ করে তবে তা স্বামীর মানা উচিত; বরং নিজে থেকেই হওয়া উচিত। বিশেষ করে তার ভাইরা যদি অসৎ প্রকৃতির হয়। ইসলামে এটা জরুরী নয় যে, চিরদিন ভাই-ভাই মিলে একই সংসারে থাকতে হবে। যা জরুরী তা হল, আল্লাহর দ্বীন নিজেদের জীবন ও পরিবেশে কায়েম করা, আপোষে ভ্রাতৃত্ব-বোধ ও সহায়তা-সহানুভূতি রাখা। সকলে মিলে পিতা-মাতার যথাসাধ্য সেবা করা। কিন্তু হায়রে! আল্লাহতে প্রেম ও বিদ্বেষ করতে গিয়ে মানুষের মাঝে মানুষকে দুশমন হতে হয়। হারাতে হয় একান্ত আপনকে। যেহেতু, আল্লাহর চেয়ে অধিক আপন আর কে?

পর্দা নিজের কাছে নয়। কোনো ইঁদুর নিজের চোখ বন্ধ করে যদি মনে করে যে, সে সমস্ত বিড়াল থেকে নিরাপদ তবে এ তার বোকামী নয় কি? নারীর সৌন্দর্য দেখে বদখেয়াল ও কুচিন্তা আসাও মানুষের জন্য স্বাভাবিক। অতএব পর্দা না করে কি কাম লোলুপতা ও ব্যভিচারের ছিদ্রপথ বন্ধ করা সম্ভব?

নারীর মোহনীয়তা, কমনীয়তা ও মনোহারিত্ব লুকিয়ে থাকে তার লজ্জাশীলতায়। নারীর লজ্জাশীলতা তার রূপ-লাবণ্য অপেক্ষা বেশী আকর্ষণীয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا كَانَ الْفُحْشُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا شَانَهُ، وَلَا كَانَ الْحَيَاءُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا زَانَهُ»

“অশ্লীলতা বা নির্লজ্জতা যে বিষয়ে থাকে, সে বিষয়কে তা সৌন্দর্যহীন করে ফেলে; পক্ষান্তরে লজ্জাশীলতা যে বিষয়ে থাকে, সে বিষয়কে তা সৌন্দর্যময় ও মনোহর করে তোলে”।[4]

সভ্য লেবাসের পর্দা থেকে বের হওয়া নারী-স্বাধীনতার যুগে পর্দা বড় বিরল। এর মূল কারণ হল লজ্জাহীনতা। কেননা, লজ্জাশীলতা নারীর ভূষণ। ভূষণ হারিয়ে নারী তার বসনও হারিয়েছে। দ্বীনী সংযম নেই নারী ও তার অভিভাবকের মনে। পরন্তু সংযমের বন্ধন একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে উদ্দাম-উচ্ছৃঙ্খলতা বন্যার মত প্রবাহিত হয়। তাতে সংস্কার, শিক্ষা, চরিত্র, সবই অনায়াসে ভেসে যায়। শেষে লজ্জাও আর থাকে না। বরং এই লজ্জাহীনতাই এক নতুন ‘ফ্যাশন’ রূপে ‘সভ্য’ ও ‘আলোক প্রাপ্ত’ নামে সুপরিচিতই লাভ করে। সত্যই তো, বগল-কাটা ব্লাউজ ও ছাঁটা চুল না হলে কি সভ্য নারী হওয়া যায়? আধা বক্ষ-স্থল, ভুঁড়ির ভাঁজ ও জাং প্রভৃতি গোপন অঙ্গে দিনের আলো না পেলে কি ‘আলোক প্রাপ্ত’ হওয়া যায়?! [নাউযুবিল্লাহ]

বলাই বাহুল্য যে, মুসলিম নারী-শিক্ষার ‘সুবেহ সাদেক’ চায়, নারী-দেহের নয়। মুসলিম নারী-বিদ্বেষী নয়, নারী-শিক্ষার দুশমনও নয়। মুসলিম বেপর্দা তথা অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের দুশমন। শিক্ষা, প্রগতি, নৈতিকতা তথা পর্দা সবই মুসলিমের কাম্য। আর পর্দা প্রগতির পথ অবরোধ করতে চায় না; চায় বেলেল্লাপনা ও নগ্নতার পথ রুদ্ধ করতে।

পক্ষান্তরে পর্দাহীনতা; আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা।

পর্দাহীনতা; নগ্নতা, অসভ্যতা, অশ্লীলতা, লজ্জাহীনতা, ঈর্ষাহীনতা ও ধৃষ্টতা।

পর্দাহীনতা; সাংসারিক অশান্তি, ধর্ষণ, অপহরণ, ব্যভিচার প্রভৃতির ছিদ্রপথ।

পর্দাহীনতা; যৌন উত্তেজনার সহায়ক। মানবরূপী শয়তানদের চক্ষুশীতলকারী।

পর্দাহীনতা; দুষ্কৃতীদের নয়নাভিরাম।

পর্দাহীনতা; কেবল ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে নারী-স্বাধীনতা নয়, বরং সভ্য পরিচ্ছদের ঘেরাটোপ থেকে নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ ও দেহ মুক্তির নামান্তর।

পর্দাহীনতা; কিয়ামতের কালিমা ও অন্ধকার।

পর্দাহীনতা; বিজাতীয় ইবলীসী ও জাহেলিয়াতি প্রথা। বরং সভ্য যুগের এই নগ্নতা দেখে জাহেলিয়াতের পর্দাহীনারাও লজ্জা পাবে। বেপর্দার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে কোনো পর্দা নেই।

[1] সমাজে প্রচলিত থাকার কারণেই বলা হলো, নতুবা পীর প্রথার অনুমোদন ইসলামে নেই। [সম্পাদক]

[2] সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬

[3] সূরা নূর, ৬০

[4] ইবনু মাজাহ, হাদিস: ৪১৮৫; তিরমিযি, হাদিস: ১৯৭৪