বর্তমান সময়ে যিনা-ব্যভিচার একটি মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে এ ব্যাধি এত মারাত্মক আকার ধারণ করছে যে প্রায় প্রতিটি ফ্লাট বাড়ী একটি যৌন কেন্দ্র। অভিজাত ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরা এ সব অপকর্মকে কোনো অন্যায় মনে করছে না। তারা মনে করছে এটি তাদের তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ও স্বাধীনতা। তারা উন্নত বিশ্বকে তাদের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করছে। তারা বলে উন্নত বিশ্বের মেয়েরা রাস্তা-ঘাট, হোটেল, পার্ক সব জায়গায় যেভাবে যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে ঘরে ফিরে, তারাও এমন সমাজ ব্যবস্থার পক্ষপাতি। এ সব যেনা-ব্যভিচারের কারণে আজ সমাজে অশান্তি, মানবতার হাহাকার।

সত্য বলেছেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সত্য তাঁর নবুওয়তের অহীলব্ধ ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলেছেন,

«يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ، وَأَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ: لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ، إِلَّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ، وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ، وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ، إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا، وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللَّهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلَّا سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ، وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ، إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ».

“হে মুহাজিরদল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর। যখনই কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারী ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না। যখনই কোনো জাতি ওজন ও মাপে কম দিতে আরম্ভ করবে তখনই তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, জীবন-নির্বাহের কষ্ট ও শাসককুলের অত্যাচার পেয়ে বসবে। আর যখনই কোনো জাতি সম্পদের যাকাত প্রদানে বিরত থাকবে তখনই তাদের মধ্যে আকাশ থেকে অনাবৃষ্টি দেখা দিবে। যদি না জীব-জন্তু থাকত, তাদের মোটেই বৃষ্টি দেওয়া হতো না। আর যখনই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে তখনই তাদের অধিকৃত বস্তুর কিছু হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যখনই কোনো জাতির নেতারা আল্লাহর কিতাব কুরআন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা ত্যাগ করবে এবং তা থেকে হুকুম পছন্দ করে গ্রহণ করবে না তখনই তাদের মধ্যে পরস্পর ভীতির সঞ্চার করবেন।”[1]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখনই কোনো জাতি তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তখনই তাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যখনই কোনো জাতির মাঝে অশ্লীলতা আত্মপ্রকাশ করে তখনই সে জাতির জন্য আল্লাহ মৃত্যুকে আধিপত্য প্রদান করেন। (তাদের মধ্যে মৃতের হার বেড়ে যায়।) আর যখনই কোনো জাতি যাকাত-দানে বিরত হয় তখনই তাদের জন্য (আকাশের) বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়।”[2]

অবৈধ যৌনাচারের ফলে প্রাদুর্ভূত বিভিন্ন পুরনো রোগ তো আছেই। গনোরিয়া, সিফিলিস, শুক্র-ক্ষরণ প্রভৃতি যৌনরোগ ব্যভিচারীদের মাঝেই আধিপত্য বিস্তার করে। গনোরিয়া বা প্রমেহ রোগে জননাঙ্গে ঘা ও জ্বালা সৃষ্টি হয় এবং সেখান হতে পুঁজ নিঃসরণ হয়। মূত্রনালি জ্বালা করে, সুড়সুড় করে। মূত্রত্যাগে কষ্ট হয়। পানির মত প্রস্রাবের পর হলুদ পুঁজযুক্ত পদার্থ বের হয়। সে সঙ্গে মাথা ধরা ও ঘোরা, জ্বর এবং নিম্ন-গ্রন্থি-স্ফীতি তো আছেই।

সিফিলিস বা উপদংশ রোগ শরীরে প্রবেশ করার পর সপ্তাহ মধ্যে লাল দাগ ও ফুস্কুড়ি প্রকাশ পায়। এরপর হতে শরীর অনবরত চুলকায় ও তার চারিধারে প্রবাহযুক্ত পানি-ভরা ফোস্কা দেখা দেয় এবং ঐ সব ফুস্কুড়ি হতে পরে গলে ঘা হয় ও পুঁজ বের হয়। রোগ পুরনো হলে নখ খসে যায়, চুল ওঠে এবং সর্বাঙ্গে বিভিন্ন রোগ ও রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়।

আর শুক্র-ক্ষরণ রোগে তরল বীর্য যখন-তখন ঝরতে থাকে। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ধরে ও ঘোরে ইত্যাদি।

সুতরাং এমন সব রোগের কথা শুনে শঙ্কিত হওয়া উচিত ব্যভিচারীকে। ক্ষণস্থায়ী সে স্বাদে লাভ কি, যার পরে আছে দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী বিষাদ।

ব্যভিচার ব্যভিচারীর জন্য সাংসারিক ও পারিবারিক লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আত্মীয়স্বজনের সামনে হতে হয় অপমানিত। কারণ, ব্যভিচারী যতই সতর্কতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করুক না কেন, একদিন না একদিন তার সে পাপ-রহস্য মানুষের সমাজে প্রকাশ পেয়েই যায়। ফলে তার ব্যাপারে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে একটা এমন দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে, যার দরুন সে প্রায় সকলের কাছে নিন্দার্হ ও ঘৃণার্হ হয়। সহজে কেউ তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অনেক সময় তার কারণে তার পুরো বংশ ও পরিবারেরই বদনাম হয়। শেষে পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, ভালো লোকেরা তাদের সহিত কোনো সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অবশ্য ‘কানা বেগুনের ডগলা খদ্দের’ তো আছেই।

পক্ষান্তরে ব্যভিচারীর জীবনে লাঞ্ছনা যখন আসে, তখন তার হৃদয়ের জ্যোতি বিলীন হয়ে যায় এবং মন ভরে ওঠে অন্ধকারে। অপমানের পর এমনও হয়ে থাকে যে, শেষে সে একজন নির্লজ্জ ধৃষ্টতে পরিণত হয়ে যায়। সমাজে চলার পথে তার আর কোনো প্রকার ‘হায়া-শরম’ বলতে কিছু থাকে না। আর যার লজ্জা থাকে না, তার কিছু থাকে না। লজ্জাহীনের পূর্ণ ঈমানও থাকে না। যার ফলে মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়ে যায় এবং পশুর পশুত্ব এসে স্থান নেয় তার মনে ও আচরণে।

ব্যভিচারীর মনে সব সময় এক প্রকার ভয় থাকে। অন্তরে বাসা বাঁধে সার্বক্ষণিক লাঞ্ছনা। যেমন আল্লাহর আনুগত্যে থাকে সম্মান ও মনের প্রফুল্ল­তা। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ كَسَبُواْ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ جَزَآءُ سَيِّئَةِۢ بِمِثۡلِهَا وَتَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ ٢٧ ﴾ [يونس : ٢٧]

“যারা মন্দ কাজ করে, তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে---।”[3] ব্যভিচারী সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। জারজ জন্ম নিলে তো আরও। এ ছাড়া ব্যভিচারের ফলে তার সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদা যায়, স্ত্রী-কন্যার ব্যাপারে ঈর্ষা থাকে না। বরং ব্যভিচারী মিথ্যাবাদীও হয়, খেয়ানত-কারী ও ধোকাবাজ হয়। সাধারণত: বন্ধুর বন্ধুত্বের মানও খেয়াল রাখে না[4]।

ব্যভিচারী দ্বীনী ইলম থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ইলম হলো আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোনো পাপিষ্ঠকে দেওয়া হয় না, তথা পাপের কালিমা সে জ্যোতিকে নি®প্রভ করে ফেলে।

ব্যভিচার এমন এক ‘ফ্রি সার্ভিস’ চিত্তবিনোদনের সুন্দর উপায় যে, ব্যভিচারীকে বিবাহ করে ঘর-সংসার করতে বাধা দেয়। তাকে বিবাহে আগ্রহহীন ও নিঃস্পৃহ করে তোলে। বিনা খরচ ও পরম স্বাধীনতায় যদি কাম-চরিতার্থ করা সহজ হয় এবং স্বামীর কোনো প্রকার দায়িত্ব ঘাড়ে না নিয়েই যদি মনের মত ‘বউ’ পাওয়া যায়, তবে কে আর বিয়ে করবে? ব্রিটেনের প্রায় ৯০ শতাংশ যুবক-যুবতী এই দায়-দায়িত্বহীন সম্পর্ককেই পছন্দ করে এবং বিবাহে জড়িয়ে পড়াকে বড্ড ঝামেলার কাজ মনে করে![5]

ব্যভিচার স্বামী-স্ত্রীর সংসারে ফাটল ধরায়। কারণ, অন্যাসক্ত স্বামীর মন পড়ে থাকে অন্য যুবতীর প্রতি। অনুরূপ অন্যাসক্তা স্ত্রীর মন পড়ে থাকে কোনো অন্য রসিক নাগরের যৌবন-আসনে। আর এই উভয়ের মাঝে সন্দেহ বাসা বাঁধে। একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সন্দেহ হয় স্বামীর নিজের সন্তানের ব্যাপারেও। প্রতিবাদ ও কৈফিয়ত হলে কলহ বাধে। অতঃপর চলে মারধর। আর তারপরই তালাক অথবা খুন!

ব্যভিচার পিতার পিতৃ-বোধ এবং মাতার মাতৃ-বোধ বিনষ্ট করে ফেলে। পিতৃ ও মাতৃবৎশল্য সন্তানদের উপর থেকে উঠে যায়। যেমন অনেকের জানতে বা অজান্তে সমাজে পয়দা হয় হাজারো জারজ সন্তান।

ব্যভিচার সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনে। ধর্ষণের ভয়ে কিশোরী-যুবতীর নিরাপত্তা থাকে না। এমন কি নিরাপত্তা থাকে না কোনো সুদর্শন কিশোরও! বাড়ির ভিতরে থেকেও মনের আতঙ্কে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পায় না তারা। অনেকে ঐ শ্রেণীর হিংস্র নেকড়ের পাল্লায় পড়ে জীবন পর্যন্তও হারিয়ে বসে।মানসিক বিপর্যয় ঘটিয়েই ব্যভিচার বহু সমাজ-বিরোধী অপরাধী সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে পিতা-মাতার স্নেহ ও মায়া-মমতা থেকে বঞ্চিত জারজ সন্তানরা মানসিক কঠোরতা ও সামাজিক ঘৃণার মাঝে মানুষ হতে থাকে এবং পরিশেষে অপরাধ জগৎকেই মনের মত জগত বলে নিজের জন্য বেছে নয়।

>
[1] ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪০১৯, সহীহ তারগীব, হাদিস: ৭৫৯

[2] হাকেম, হাদিস: ২/১২৬, বাইহাকী, হাদিস: ৩/ ৩৪৬, বায্যার, হাদিস: ৩২৯৯ , সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদিস: ১০৭

[3] সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৭

[4] ইবনুল কাইয়্যেম, রওদাতুল মুহিব্বীন।

[5] আল-ইফ্ফাহ পৃ. ১৯।