যারা মাদককে হালাল বলে তাদের দুটি উপায়ে সংশোধন করতে হবে:-

এক: কোনো বস্তুকে অন্য নামে নামকরণ দ্বারা বস্তুর আসল রূপ পরিবর্তন হয় না। আর শরীয়তের সব বিধানই হল, স্পষ্ট, মজবুত ও শক্তিশালী। শরিয়তের বিধান দ্বারা কোনো প্রকার খেল-তামাশা করা বৈধ নয়। সুতরাং, যে নামেই নাম করণ করা হোক না কেন, তার মধ্যে যখন কারণ- নেশা-পাওয়া যাবে, তখন তা সেবন বা পান হারাম হবে। এমনকি যদি আমরা মদকে পানিও নাম রাখি, তা হলেও তা হারাম হবে। কারণ, হাদিসে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যে পানীয় দ্বারা মানুষের মস্তিষ্ক নষ্ট হয়, তা হারাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«كل شراب أسكر فهو حرام»

“যে কোনো ধরনের নেশাজাত পানীয় হারাম”[1]।

অনুরূপভাবে রাসূল সা. বলেন,

«كل مسكر خمر، وكل مسكر حرام»

“নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্যই মাদক, আর যাবতীয় মাদকই হারাম[2]।”

আর যারা মদ পান করাকে বৈধ দাবী এবং হালাল মনে করে তাদের বলা হবে, আল্লাহ তা‘আলা যে সব বস্তুকে হারাম করেছে, তাকে হালাল মনে করা দ্বারা একজন মানুষ ইসলামের বন্ধন থেকে বের হয়ে যায়। শেখ সুলাইমান আত-তামিমী রহ. বলেন, যে সব বস্তু নিষিদ্ধ হওয়া বা হালাল হওয় বিষয়ে উম্মতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে ধরনের হালাল বা হারাম মনে করা কুফর। কারণ, আল্লাহ ও তার রাসূল যে বস্তুকে হালাল করেছেন, তার হালাল হওয়াকে অস্বীকার করা যাবে না এবং যে বস্তুকে হারাম করেছে তাকে হালাল বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। এ ধরনের ধৃষ্টতা কেবল সেই দেখাতে পারে যে ইসলামের দুশমন, ইসলামের বিধি-বিধান অস্বীকারকারী এবং কুরআনও সুন্নাহ এবং উম্মতের ইজমাকে অমান্যকারী।

দুই: পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের হেফাযত করা একজন মানুষের জন্য খুবই জরুরী। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের হেফাযত ছাড়া ইসলামের মাকাসেদ তথা মূল উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ইসলামের মাকাসেদকে সংরক্ষণ করার জন্য পরিপূর্ণ চেষ্টা করা একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু মদ মানুষের জ্ঞানকে নষ্ট করে দেয় যা একজন মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। মদ মানুষের জ্ঞানকে বিলুপ্ত করে, চিন্তা-ফিকিরকে নষ্ট করে দেয়। একজন মানুষ যাতে তার জ্ঞানহারা না হয়, এ কারণে আল্লাহ মানুষকে মদ পান হতে কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে মদ থেকে দূরে থাকার জন্য সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার নিষেধ করেন, যার মধ্যে কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বা বিকৃতির সুযোগ নাই। এ কারণেই ইমাম কুরতবী রহ. আল্লাহ তা‘আলার বাণী فاجتنبوه এর তাফসীরে বলেন, আল্লাহর এ কথাটি দ্বারা মদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাকে বুঝায়। ফলে মদ থেকে কোনো উপায়ে কোনো প্রকার উপকার গ্রহণ করা যাবে না। মদ পান করা যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, শরবত বানানো যাবে না, ঔষধ বানানো যাবে না ইত্যাদি। ইমাম ইবন মাজাহ আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,

«لا تشربوا الخمر؛ فإنها مفتاح كل شر»

“তোমরা মদ সেবন করো না, কারণ, মদ সমস্ত অনিষ্টতার চাবি-কাঠি”।[3]

মদের ক্ষতি শুধু দু একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর ক্ষতি এত ব্যাপক- যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা মদ সেবন করাকে শুধু হারাম বা নিষিদ্ধ করেননি বরং মদ বিক্রি করা, তৈরি করা, আমদানি-রফতানি বিপণনসহ যাবতীয় সব কিছুকেই নিষিদ্ধ করেন। যারা মদের বাণিজ্য করে, তাদের ব্যাপারেও কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। যারা মদ পান করে তারা আখেরাতে এ জাতীয় পানীয় থেকে বঞ্চিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন ওমরের হাদিস বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«من شرب الخمر في الدنيا فمات وهو يدمنها لم يتب، لم يشربها في الآخرة»

“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করে এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাওবা না করে মারা যায়, সে আখিরাতে ঐ জাতীয় কোনো পানীয় পান করতে পারবে না।[4] আর জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণিত, তাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وإن على الله لعهدا لمن شرب المسكر أن يسقيه من طينة الخبال: عرق أهل النار»

“যারা দুনিয়াতে মাদক সেবন করে, তাদেরকে আখিরাতে জাহান্নামীদের দেহের পচা-গলা, পুঁজ ও ঘাম পান করানো বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”[5] অনুরূপভাবে আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি মারফু হাদিস বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لا يدخل الجنة مدمن خمر»

“নেশাকরায় অভ্যস্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।[6]

আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরও একটি হাদিস বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«من شرب الخمر لم تقبل له صلاةٌ أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد الرابعة لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب لم يتب الله عليه، وسقاه من نهر الخبال».

“যে ব্যক্তি মদ পান করে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করা হবে না। যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবেন না। তারপর যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবেন না। যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে চতুর্থবার পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবে না। তারপর যদি তাওবা করে তার তাওবা কবুল করা হবে না। আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের পচা-গলা ও পুঁজের নহর থেকে পান করাবেন”।[7] যারা প্রবৃত্তির পূজারি তাদের নিকট এ ধরনের উপদেশ অনেক সময় অমূলক। যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের আখিরাতের ওয়াজ ও নছিহত দ্বারা মদ পান করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। এ ধরনের লোকদের নিকট মদ পান বা নেশাজাত দ্রব্য পান করা দুনিয়াবি ক্ষতিগুলো তুলে ধরতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, মদ পান করা বা নেশা গ্রহণ করা কেবল শরীয়তের পরিপন্থীই নয় বরং নেশাজাত বস্তু সেবন করা দ্বারা একজন মানুষ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিক ঠেলে দেওয়া হয়। মদ পানের কারণে ঘরে বাইরে অশান্তি তৈরি হয়, বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়, মারা-মারি হানা-হানি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও রয়েছে একজন মানুষের দৈহিক ক্ষতি। মাদক সেবন দ্বারা বড় বড় রোগ-ক্যানসার, যক্ষ্মা ইত্যাদি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি দেখা দেয়। এত কিছুর পরও কি বলা যাবে, মাদক সেবন করা বৈধ এবং তা নিষিদ্ধ এবং হারাম নয়?

>
[1] বুখারী, হাদিস, ৫৫৮৫।

[2] মুসলিম, হাদিস: ৫০০৫।

[3] ইবন মাজাহ, হাদীস নং, ৩৩৭১; হাকিম, হাদিস: ৭২৩১; হাদিসটি সহীহ বুখারি মুসলিম এর শর্ত অনুযায়ী।

[4] বর্ণনায় মুসলিম, হাদিস: ২০০৩, নাসায়ী, হাদিস: ৫৬৭৩।

[5] বর্ণনায় মুসলিম, হাদিস: ২০০২।

[6] ইব্নু মাযা, হাদিস: ৩৩৭৬ ইবনু হাব্বান, হাদিস: ৬১৩৭।

[7] বর্ণনায় তিরমিযি, হাদিস: ১৮৬২।